Go to full page →

দ্বাদশ অধ্যায় SC 112

সন্দেহ ভঞ্জন। (WHAT TO DO WITH DOUBT) SC 112

অনেকেই বিশেষতঃ যাহারা খ্রীষ্টীয় জীবন নূতন আরম্ভ করিয়াছে, মাঝে মাঝে সন্দেহ-পীড়িত হইয়া থাকে। বাইবেলে এরূপ অনেক বিষয় আছে, যাহা তাহারা অর্থ করিতে, অথবা বুঝিতে পারে না এবং শয়তান এই সুযোগ গ্রহণ করিয়া, ধর্মশাস্ত্র যে ঈশ্বরের প্রকাশিত সত্য, তাহাদের এই বিশ্বাস শিথিল করিয়া দেয়। তাহারা এইরূপ প্রশ্ন তুলিয়া থাকে, “কিরূপে আমি ঠিক পথ জানিতে পারিব? বাইবেল যদি সত্য সত্যই ঈশ্বরের বাক্য হয়, তবে কিরূপে আমি এই সমুদয় সন্দেহ ও জটিলতা হইতে মুক্ত হইতে পারি?” SC 112.1

বিশ্বাস করিবার যথেষ্ট প্রমাণ না দিয়া ঈশ্বর কখনও আমাদিগকে বিশ্বাস করিতে বলেন না। তাঁহারা অস্তিত্ব, স্বভাব ও তাঁহারা বাক্যের যথার্থতা- এই সমুদয়ই এরূপ প্রচুর সাক্ষ্যের উপরে প্রতিষ্ঠিত, যাহা আমাদের যুক্তির পক্ষে অনুকূল। তথাপি ঈশ্বর সন্দেহ করিবার সম্ভাবনা একেবারে লোপ করেন নাই। আমাদের বিশ্বাস সাক্ষ্যের উপরে প্রতিষ্ঠিত হইবে, প্রমাণের উপরে নহে। যাহারা সন্দেহ পোষণ করিতে চায়, তাহাদের যথেষ্ট সুযোগ মিলিবে ; আর যাহারা বাস্তবিক সত্য কি তাহা জানিতে ব্যাকুল হয়, তাহারা তাহাদের বিশ্বাসের ভিত্তি স্বরূপ প্রচুর প্রমাণ পাইতে পারিবে। SC 112.2

সঙ্কীর্ণ, সীমাবদ্ধ মনের পক্ষে অনন্ত পুরুষের স্বভাব ও কার্য্যাবলী, সম্যক ধারণা করা অসম্ভব। তীক্ষ্ণ বুদ্ধি সম্পন্ন, অতি উচ্চ শিক্ষিত ব্যক্তির নিকটেও এই পবিত্র পুরুষ চির প্রহেলিকায় সমাচ্ছন্ন থাকিবেন। “তুমি কি অনুসন্ধান দ্বারা ঈশ্বরকে পাইতে পার? সর্ব্বশক্তিমানের সম্পূর্ণ তত্ত্ব পাইতে পার? সে তত্ত্ব গগনবৎ উচ্চ; তুমি কি করিতে পার? পাতাল অপেক্ষাও অগাধ ; তুমি কি জানিতে পার?” (ইয়োব ১১:৭,৮)। SC 112.3

প্রেরিত পৌল বলিয়াছেন, “আহা ! ঈশ্বরের ধনাঢ্যতা ও প্রজ্ঞা ও জ্ঞান কেমন অগাধ ! তাঁহার বিচার সকল কেমন বোধাতীত ! তাঁহার পথ সকল কেমন অননুসন্ধেয় !” (রোমীয় ১১:৩৩)। কিন্তু যদিও “মেঘ ও অন্ধকার তাঁহার চারিদিকে বিদ্যমান,” তথাপি “ধর্ম্মশীলতা ও বিচার তাঁহার সিংহাসনের ভিত্তিমূল” (গীত ৯৭:২)। আমাদের প্রতি ঈশ্বরের ব্যবহার ও অভিপ্রায় সম্বন্ধে আমরা শুধু এই মাত্র ধারণা করিতে পারি যে অনন্ত শক্তির সহিত অপার করুণা ও প্রেম মিশ্রিত হইয়া রহিয়াছে। তাঁহার অভিপ্রায় যতটুকু জানিলে আমাদের মঙ্গল হয় আমরা ঠিক ততটুকু জানিতে পারি ; উহার বেশী জানিতে হইলে আমাদের তাঁহারই উপরে নির্ভর করিতে হইবে, যিনি সর্বশক্তিমান ও প্রেমময়। SC 113.1

ঈশ্বরের বাক্য, তাঁহার নিজ চরিত্রের ন্যায় নিগূঢ় রহস্যপূর্ণ ; সসীম মানুষ কখনও উহা সম্পূর্ণ হৃদয়ঙ্গম করিতে পারে না। জগতে পাপের প্রবেশ, খ্রীষ্টের নরদেহে আবির্ভাব, পুনর্জ্জন্ম, পুনরুত্থান প্রভৃতি আরও অনেক বাইবেলোক্ত বিষয় এত গভীর অর্থপূর্ণ যে উহা বুঝিতে পারা বা অপরকে বুঝাইয়া দেওয়া মানুষের পক্ষে দুরূহ। কিন্তু আমরা ঐশ্বরিক বিধানের গূঢ় রহস্য বুঝিতে পারি না বলিয়া আমাদের ঈশ্বরের বাক্য সম্বন্ধে সন্দেহ পোষণ করিবার কোনই কারণ নাই। প্রাকৃতিক জগতে আমরা সর্ব্বদা এত রহস্যপূর্ণ ব্যাপার দ্বারা বেষ্টিত রহিয়াছি যাহাদের কারণ নির্দ্দেশ করা আমাদের পক্ষে অসম্ভব। অতিশয় সাধারণ একটি জীবনও এরূপ সমস্যাপূর্ণ যে অতিশয় বিজ্ঞ দার্শনিকও তাহা সমাধান করিতে অসমর্থ। সর্ব্বত্র এরূপ বিস্ময়কর বস্তু রহিয়াছে যাহা কখনও আমদের জ্ঞানগোচর হইবে না। তবে আত্মিক জগতে আমাদের বুদ্ধির অগম্য কোন নিগূঢ় বিষয় থাকিলে আমরা বিস্মিত হইব কেন? মানব মনের সঙ্কীর্ণতা ও দুর্ব্বলতাই এই দুর্ব্বোধের কারণ। ধর্ম্মশাস্ত্রের ঐশ্বরিক প্রকৃতি সম্বন্ধে ঈশ্বর আমাদিগকে যথেষ্ট প্রমাণ দিয়াছেন ; যদি আমরা তাঁহার বিধানের নিগূঢ় রহস্য বুঝিতে না পারি, তবে তাঁহার বাক্যে সন্দেহ করা উচিত নহে। SC 113.2

প্রেরিত পিতর বলিয়াছেন যে ধর্ম্মশাস্ত্রের “কোন কোন কথা বুঝা কষ্টকর ; অজ্ঞান ও চঞ্চল লকেরা............সেই কথাগুলিরও বিরূপ অর্থ করে, আপনাদেরই বিনাশার্থে করে,” (২ পিতর ৩:১৬)। সন্দেহবাদী নাস্তিকগণ ধর্ম্মশাস্ত্রের কঠিন পদগুলি তুলিয়া বাইবেল সম্বন্ধে বিরুদ্ধ মত উপস্থিত করিয়া থাকে ; কিন্তু বিরুদ্ধ হওয়া ত দূরের কথা , ঐ সকল পদ দ্বারা, বরং উহা যে ঈশ্বর নিশ্বসিত, তাহাই দৃঢ়রূপে প্রমাণিত হয়। যদি উহাতে ঈশ্বরের কোন বিবরণ না থাকিয়া শুধু আমরা যাহা বুঝিতে পারি, তাহাই থাকিত, যদি তাঁহার মহত্ত্ব ও বিশালতা সসীম মানব বুদ্ধি অনায়াসে ধারণা করিতে পারিত, তবে বাইবেল কখন ঐশ্বরিক প্রামাণ্যের অভ্রান্ত নিদর্শন বহন করিত না। বিষয়ের গাম্ভীর্য্য ও রহস্য, উহা যে ইসশর-বাক্য, সেই সম্বন্ধে বিশ্বাস জন্মাইবে। SC 114.1

বাইবেল মানব হৃদয়ের অভাব ও বাসনানুযায়ী এরূপ সরল ও সম্পূর্ণভাবে সত্য প্রকাশ করিয়াছে যে অতিশয় উচ্চ শিক্ষিত ব্যক্তিগণও উহা দ্বারা মুগ্ধ ও বিস্মিত হয় এবং সাধারণ, অশিক্ষিত লোকেরা পরিত্রানের পন্থা নির্দ্ধারণ করিতে সমর্থ হইয়া থাকে। অথচ এত সরল ভাবে বর্ণিত সত্যসমূহ এরূপ উচ্ছ, দুর-প্রভাব বিস্তারী ও মানব বুদ্ধির ধারণাতীত বিষয় সম্বন্ধে আলোচনা করিয়াছে যে উহা ঈশ্বর কর্ত্তৃক প্রচারিত হইয়াছে, শুধু এই কারণেই আমরা গ্রহণ করিতে পারি। এই প্রকারে আমাদের সম্মুখে পরিত্রাণের উপায় প্রকাশিত হইয়াছে যেন ঈশ্বরের নির্দ্দিষ্ট পন্থানুযায়ী পরিত্রাণ লাভ করিবার জন্য প্রত্যেক আত্মা অনুতাপ দ্বারা ঈশ্বরের এবং বিশ্বাস দ্বারা প্রভু যীশু খ্রীস্টের পানে ক্রমে ক্রমে চালিত হইতে পারে ; তথাপি অতি সহজে বোধগম্য সত্যসমূহের অন্তরালে তাঁহার গৌরবকে আবৃত করিয়া এরূপ নিগূঢ় রহস্য রহিয়াছে, যাহা অনুন্ধান করিতে গেলে মন অভিভূত হইয়া যায় অথচ অকপট সত্যান্বেষী ব্যক্তি শ্রদ্ধায় অ বিশ্বাসে অনুপ্রাণিত হইয়া থাকে। সে বাইবেলখানি যত অধিক অনুসন্ধান করিবে, ততই তাহার বিশ্বাস দৃঢ়তর হইতে থাকিবে যে উহা জীবন্ত ঈশ্বরের বাক্য এবং তখন ঐশ্বরিক প্রত্যাদেশের মহিমার সম্মুখে মানব বুদ্ধি অবনত হইয়া যাইবে। SC 114.2

বাইবেলের মহান্ সত্যসমূহ আমরা সম্পূর্ণরূপে ধারণা করিতে অসমরথ,-এইরুপ স্বীকার করিলে শুধু ইহাই মানিয়া লওয়া হয় যে মানুষের সসীম মন কখনও অসীমের মর্ম্ম গ্রহণ করিতে পারে না ; আর মানুষ তাহার সীমাবদ্ধ জ্ঞান লইয়া সর্ব্বজ্ঞ পরমেশ্বরের অভিপ্রায় বুঝিতে পারে না। SC 115.1

অবিশ্বাসী, নাস্তিকের দল এই নিগূঢ় রহস্যের কিনারা না পাইয়া ঈশ্বরের বাক্য পরিহার করে; তারপর যাহারা বাইবেলে বিশ্বাস করে বলিয়া ঘোষণা করে, তাহারাও এই বিষয়ে বিপদমুক্ত নহে। প্রেরিত পুরুষ বলিয়াছেন, “ভ্রাতৃগণ, দেখিও, পাছে অবিশ্বাসের এমন মন্দ হৃদয় তোমাদের কাহারও মধ্যে থাকে যে, তোমরা জীবন্ত ঈশ্বর হইতে সরিয়া পড়” (ইব্রীয় ৩:১২)। বাইবেলের উপদেশসমূহ মনজগ সহকারে পাঠ করা এবং শাস্ত্রে যতদূর প্রকাশিত হইয়াছে ততদূর “ঈশ্বরের গভীর বিষয় সকল” (১ করি ২:১০) অনুসন্ধান করা কর্ত্তব্য। “নিগূঢ় বিষয় সকল আমাদের ঈশ্বর সদাপ্রভুর অধিকার” বটে, “কিন্তু প্রকাশিত বিষয় সকল আমাদের..................অধিকার” (দ্বিঃ বিঃ ২৯:২৯)। কিন্তু এই প্রকার অনুসন্ধান করিবার মানসিক শক্তি বিকৃত করাই শয়তানের কার্য্য। বাইবেলোক্ত সত্যের বিচার বা আলোচনার সহিত একটু অহঙ্কারের ভাব জড়িত রহিয়াছে, তাই মনুষ্যেরা তাহাদের তৃপ্তি মত শাস্ত্রের প্রত্যেক অংশ ব্যাখ্যা করিতে না পারিলে অধীর অ অপ্রতিভ হইয়া যায়। ইসসর-নিশ্বসিত বাক্য তাহারা বুঝিতে পারে না, এরূপ স্বীকার করা যেন তাহাদের পক্ষে বড়ই অপমান জনক। ঈশ্বর যে পর্য্যন্ত তাহাদের নিকটে সত্য প্রকাশ করা উপযুক্ত মনে করিবেন, সেই পর্য্যন্ত তাহারা ধীরভাবে অপেক্ষা করিতে অনিচ্ছুক। তাহারা মনে করে যে শাস্ত্রের অর্থ গ্রহণ করিতে মানব বুদ্ধি অপর কোন সাহায্য ব্যতীত সম্পূর্ণ সমর্থ, তাই ব্যর্থকাম হইয়া তাহারা উহার প্রামাণ্য একেবারে অস্বীকার করিয়া ফেলে। এ কথা সত্য বটে যে বাইবেল হইতে প্রাপ্ত বা সংগৃহীত বলিয়া কথিত বহু মতবাদ ও সিদ্ধান্তের ভিত্তি উহার উপদেশে নাই, বরং উহারা সমুদয় ঈশ্বর-নিশ্বসিত বাক্যের সম্পূর্ণ বিপরীত। এই সকল বিষয় অনেককে সন্দেহাকুল ও ব্যতিব্যস্ত করিয়া তুলিয়াছে। সুতরাং মানুষের বিকৃত বুদ্ধি দোষে এইরূপ হইয়াছে, ঈশ্বরের বাক্যের দোষে নহে। SC 115.2

ঈশ্বর ও তাঁহার কার্য্যাবলী সম্বন্ধে সম্পূর্ণ জ্ঞান লাভ করা যদি সৃষ্ট জীবের পক্ষে সম্ভব হইত, তবে সেই সীমানা পর্য্যন্ত পৌঁছিলে পর তাহাদের আর সত্য সম্বন্ধে নূতন কিছু জানিবার, জ্ঞানের মাত্রা আরও বৃদ্ধি করিবার এবং হৃদয় ও মনকে আরও সুপরিস্ফুষ্ট করাই তুলিবার কোনই সম্ভাবনা থাকিত না। ঈশ্বর তাহা হইলে আর সর্ব্বপ্রধান থাকিতে পারিতেন না এবং মানুষও জ্ঞান ও সাধনার চরম সীমানা পর্য্যন্ত পৌঁছিয়া আর উন্নতি-পথে অগ্রসর হইতে পারিত না। এই প্রকার সম্ভব হয় নাই বলিয়া আমরা ঈশ্বরকে ধন্যবাদ দিতেছি। ঈশ্বর অনন্ত ; তাঁহাতে “জ্ঞানের ও বিদ্যার সমস্ত নিধি গুপ্ত রহিয়াছে” (কল ২:৩)। অনন্ত কাল ধরিয়া মানুষ অনুসন্ধান ও তত্ত্বান্বেষণ করিয়াও তাঁহারা প্রজ্ঞা, মহত্ত্ব ও শক্তির অফুরন্ত ভাণ্ডার শেষ করিতে পারিবে না। SC 116.1

ঈশ্বর ইচ্ছা করেন যেন এই জীবনেই তাঁহারা বাক্যনিহিত সত্যসমূহ তাঁহারা লোকদের নিকটে ক্রমাগত প্রকাশিত হইতে থাকে। এইরূপ জ্ঞান লাভ করিবার একমাত্র পন্থা আছে। যে আত্মা দ্বারা বাক্য দত্ত হইয়াছে শুধু সেই আত্মার জ্ঞানালোক দ্বারাই আমাদের নিকটে ঈশ্বর-বাক্যের অর্থ প্রকাশ হইতে পারে। “ঈশ্বরের বিষয়গুলি কেহ জানে না, কেবল ঈশ্বরের গভীর বিষয় সকলও অনুসন্ধান করেন” (১ করি ২:১১,১০)। ত্রাণকর্ত্তা,তাঁহার শিষ্যগণের নিকটে অঙ্গীকার করিয়াছিলেন, -“পরন্ত তিনি, সত্তের আত্মা, যখন আসিবেন, তখন পথ দেখাইয়া তমাদিগকে সমস্ত সত্যে লইয়া যাইবেন;.....................কেননা যাহা আমরা, তাহাই লইয়া তোমাদিগকে জানাইবেন” (যোহন ১৬:১৩,১৪) SC 117.1

মানুষ তাহার বুদ্ধি শক্তির চালনা করুক, ঈশ্বরের ইহাই বাসনা ; বাইবেল পাঠে মন যেরূপ উন্নত ও সবল হইবে, অপর কিছু পাঠ করিলে সেইরূপ হইবে না। কিন্তু বুদ্ধি শক্তিকে অভ্রান্ত মনে করিয়া অত্যুচ্চ স্থান দিলে চলিবে না ; আমাদের বুদ্ধিশক্তি মানবের জরাজীর্ণতা হেতু দুর্ব্বল হইয়া পড়িয়াছে। যদি শাস্ত্র দ্বারা আমাদের বুদ্ধিকে মেঘাচ্ছন্ন করিবার ইচ্ছা না থাকে, যাহার ফলে সহজ সত্তগুলিও ধারনাতীত বলিয়া অনুভূত হইবে, তবে আমাদের শিশুর ন্যায় বিশ্বাস ও সরলতা সহকারে পবিত্র আত্মার সাহায্য ভিক্ষা করিয়া শাস্ত্রপাঠে নিরত হইতে হইবে। একদিকে ঈশ্বরের জ্ঞান ও শক্তি, অন্যদিকে তাঁহার মহত্ত্ব হৃদয়ঙ্গম করিতে অক্ষমতা, এই প্রকার রোধ আমাদিগকে বিনীত করিয়া তুলিবে এবং তাহা হইলে আমরা তাঁহার সম্মুখে উপস্থিত হইবার ন্যায় পবিত্র ভীতি সহকারে তাঁহার বাক্য পাঠে রত হইব। বাইবেল পাঠ আরম্ভ করিয়া, আমাদের বুদ্ধিশক্তি অপেক্ষা শ্রেষ্ঠতর অপর কোন প্রভুত্ব মানিয়া লইতে হইবে এবং জ্ঞান ও হৃদয় সেই মহান্ পরমাত্মার সম্মুখে অবনত করিতে হইবে। SC 117.2

কতিপয় বিষয় স্বভাবতঃই কঠিন ও প্রচ্ছন্ন বলিয়া মনে হয়; কিন্তু যাহারা ঐ সকল বুঝিবার শক্তি প্রার্থনা করে, ঈশ্বর তাহাদের নিকটে উহা সহজ ও সরল করিয়া দেন। কিন্তু পবিত্র আত্মার চালনা ব্যাতীত আমরা সর্ব্বদা কেবল শাস্ত্র পদের বিকৃত অর্থ ও ভুল ব্যাখ্যা করিতে থাকিব। বাইবেলে এরূপ অনেক বিষয় আছে যাহা পাঠ করিয়া কোন লাভ নাই, বরং ক্ষতি হয়। যখন শ্রদ্ধা ও প্রার্থনা ব্যাতীত ঈশ্বর বাক্য খোলা হয়, যখন চিন্তা ও আকর্ষণ ঈশ্বরে নিবদ্ধ নহে, অথবা তাঁহার ইচ্ছার সহিত সুসঙ্গত নহে, তখনই মন সন্দেহের মেঘে সমাচ্ছন্ন হইয়া যায় এবং বাইবেল পাঠ দ্বারাই নাস্তিকতা বৃদ্ধি পায়। শত্রু তখন চিন্তারাশির উপরে প্রভুত্ব করিয়া ভুল ব্যাখ্যা যোগাইতে থাকে। মনুষ্যেরা যদি বাক্যে ও কার্য্যে ঈশ্বরের সহিত ঐক্য স্থাপন না করে, তবে তাহারা যতই বিদ্বান হৌক্ না কেন, শাস্ত্র বুঝিতে তাহাদের ভ্রম হইবে এবং তাহাদের ব্যাখ্যা গ্রহণ করা কখনও নিরাপদ নহে। যাহারা কেবল শাস্ত্রে অনৈক্যের খোঁজ করে, তাহাদের আধ্যাত্মিক সূক্ষ্ম দৃষ্টি নাই। যাহা প্রকৃত পক্ষে সরল, বিকৃত দৃষ্টি লইয়া তাহারা তাহাতে সন্দেহ ও অবিশ্বাসের বহু কারণ দেখিতে পাইবে। SC 118.1

অধিকাংশ স্থলে, পাপের প্রতি অনুরাগই সন্দেহ ও নাস্তিকতার কারণ ; যতই লুক্কায়িত থাকুক্ না কেন, এ কথা সম্পূর্ণ সত্য। পাপে অনুরক্ত, দাম্ভিক হৃদয়ের নিকটে কখনও ঈশ্বর-বাক্যের উপদেশ ও বাঁধাবাঁধি নিয়মসমূহ প্রীতিকর নহে এবং যাহারা উহার প্রয়োজনানুরূপ বিধি পালন করিতে অনিচ্ছুক তাহারা উহার প্রামাণ্য সন্দেহ করিতে প্রস্তুত আছে। সত্য লাভ করিবার উদ্দেশ্যে, সত্য কি তাহা জানিবার জন্য আমাদের আকুল বাসনা এবং উহা পালন করিবার জন্য হৃদয়ে ইচ্ছা পোষণ করিতে হইবে। যাহারা এইরূপ ভাব লইয়া বাইবেল পাঠ করিতে আরম্ভ করে তাহারা, উহা যে ঈশ্বরের বাক্য, সেই বিষয়ে যথেষ্ট প্রমাণ পাইবে এবং উহার সত্য সম্বন্ধে তাহার পরিত্রাণ লাভের উপযোগী জ্ঞান লাভ করিবে। SC 118.2

খ্রীষ্ট বলিয়াছেন, “যদি কেহ তাঁহার ইচ্ছা পালন করিতে ইচ্ছা করে, সে এই উপদেশের বিষয় জানিতে পারিবে” (যোহন ৭:১৭)। যে বিষয় না বুঝিতে পার, যদি তুমি সেই বিষয়ে অযথা প্রশ্ন ও কুতর্ক না করিয়া, তোমার অন্তরে যে আলোক রহিয়াছে, সেই আলোকের প্রতি মনোনিবেশ কর, তবে তুমি আরও অধিক আলোক প্রাপ্ত হইবে। যে সমুদয় কর্ত্তব্য সম্বন্ধে তোমার পরিষ্কার ধারণা জন্মিয়াছে, খ্রীষ্টের অনুগ্রহে সেই সকল কর্ত্তব্য সম্পন্ন কর, তাহা হইলে অপর যে গুলি সম্বন্ধে তোমার সন্দেহ রহিয়াছে, সেই সকলও বুঝিতে ও সম্পন্ন করিতে সমর্থ হইবে। SC 119.1

অতি উচ্চ শিক্ষিত এবং একেবারে নিরক্ষর—এই সকলের নিকটেই একটী প্রমাণ অবলম্বন করিতে পারে, তাহা অভিজ্ঞতা। ঈশ্বর তাঁহার বাক্যের যথার্থতা এবং অঙ্গীকারসমূহের সত্য প্রমাণ করিবার জন্য আমাদিগকে আহ্বান করিতেছেন। তিনি আমাদিগকে অনুরোধ করিতেছেন, “আস্বাদন করিয়া দেখ, সদাপ্রভু মঙ্গলময়” (গীত ৩৪:৮)। অপরের বাক্যের উপরে নির্ভর না করিয়া , আমাদের নিজেদের আস্বাদন করিতে হইবে। তিনি ঘোষণা করিয়াছেন, “যাচ্ঞা কর তাহাতে পাইবে” (যোহন ১৬:২৪)। তাঁহার অঙ্গীকার অবশ্যই সফল হইবে। কখনও উহা বিফল হয় নাই,কখনো উহা বিফল হইতে পারে না। যীশুর নিকটে অগ্রসর হইয়া, তাঁহার প্রেমের পূর্ণতায় যতই আমরা আনন্দ করিতে থাকিব,ততই আমাদের সন্দেহ ও অজ্ঞানতার অন্ধকার তাঁহার উপস্থিতির আলোকে অদৃশ্য হইয়া যাইবে। SC 119.2

প্রেরিত পৌল বলিয়াছেন যে, ঈশ্বর “আমাদিগকে অন্ধকারের কর্ত্তৃত্ব হইতে উদ্ধার করিয়া আপন প্রেম ভূমি পুত্রের রাজ্যে আনয়ন করিয়াছেন” (কল ১:১৩)। আর যে কেহ মৃত্যু হইতে জীবনে অতিক্রম করিয়াছে “সে ইহাতে মুদ্রাঙ্ক দিয়াছে যে, ঈশ্বর সত্য” (যোহন ৩:৩৩)। সে এই সাক্ষ্য দিতে পারে,--” আমার সাহায্যের প্রয়োজন হইয়াছিল এবং আমি যীশু হইতে তাহা পাইয়াছি। আমার সকল অভাব পূর্ণ হইয়াছে, আমার প্রানের ক্ষুদা মিটিয়াছে ; এইক্ষনে বাইবেল আমার কাছে প্রভু যীশু খ্রীষ্টের প্রত্যাদেশ। কেন আমি যীশু খ্রীষ্টে বিশ্বাস করি,এই প্রশ্ন করিবে কি? আমি বলিব,-- কারণ তিনি আমার ঐশ্বরিক ত্রাণকর্ত্তা। আমি বাইবেলে বিশ্বাস করি কেন? —কারণ আমি ইহাকে আমার প্রাণের নিকটে ঈশ্বরের বাণী বলিয়া পাইয়াছি। আমরা নিজেদের মধ্যেই প্রমাণ পাইতে পারি যে বাইবেল সত্য এবং প্রভু যীশু খ্রীষ্ট ঈশ্বর-পুত্র। চতুরতার সহিত কল্পিত কোন আজ্ গুবি কাহিনীর অনুসরণ করিতেছি না, একথা আমরা বেশ জানি। SC 120.1

পিতর তাঁহার ভ্রাতৃগণকে “প্রভু ও ত্রাণকর্ত্তা যীশু খ্রীষ্টের অনুগ্রহ ও জ্ঞানে বর্দ্ধিষ্ণু” (২ পিতর ৩১৮) হইতে বলিয়াছেন। ঈশ্বরের লকগণ করুণায় বৃদ্ধি পাইতে থাকিলে সর্ব্বদা তাঁহার বাক্য সম্বন্ধে আরও পরিস্ফুট জ্ঞান লাভ করিতে পারিবে। তাহারা উহার পবিত্র সত্য নিচয়ে আরও নূতন আলোক, আরও নূতন সৌন্দর্য্য দেখিতে পাইবে। সকল যুগে মণ্ডলীর ইতিহাসে এই কথা সত্য হইয়া আসিয়াছি, শেষ পর্য্যন্তও এইরূপ চলিতে থাকিবে। “ধার্ম্মিকদের পথ প্রভাতীয় জ্যোতির ন্যায়, যাহা মধ্যাহ্ন পর্য্যন্ত উত্তর উত্তর দেদীপ্যমান হয়” (হিতো ৪:১৮)। SC 120.2

বিশ্বাস বলে ঐশ্বরিক শক্তির সহিত মানবীয় শক্তি মিশ্রিত করিয়া এবং আত্মার প্রত্যেক শক্তিকে, আলক-নিধি ঈশ্বরের সংস্পর্শে আনিয়া আমরা ভবিষ্যতের পানে দৃষ্টিপাত করিতে এবং জ্ঞান বৃদ্ধির নিমিত্ত ঈশ্বরের অঙ্গীকার গ্রহণ করিতে সমর্থ হই। আমরা তাই আনন্দ প্রকাশ করিতে পারি যে ঈশ্বরের যে সকল বিধান আমাদের নিকটে জটিল বোধ হইয়াছে, তাহা তখন সহজ হইয়া যাইবে; যে সকল বিষয় বুঝিতে পারি নাই, তখন তাহাদের অর্থ বোধ হইবে; এবং যে স্থানে আমাদের সসীম মন শুধু গোলযোগ ও অসম্পূর্ণতা দেখিতে পাইয়াছি,সেই স্থানে পুনরায় আমরা শৃঙ্খলা ও অতি মধুর ঐক্য দেখিতে পাইব। “কারন এখন আমরা দর্পণে অস্পস্ট দেখিতেছি, কিন্তু তৎকালে সম্মুখাসম্মুখি হইয়া দেখিব; এখন আমি কতক অংশে জানিতে পাই, কিন্তু তৎকালে আমি আপনি যেমন পরিচিত হইয়াছি, তেমনি পরিচয় পাইব।” (১ করি ১৩ঃ১২) SC 121.1