Go to full page →

লূসিফরের হৃদয়ে দ্বন্দ্ব PPBeng 13

দূতগণ আনন্দ সহকারে খ্রীষ্টের কর্তৃত্ব স্বীকার করলেন ও তাঁর প্রতি তাদের প্রেম ও প্রশংসা জ্ঞাপন করলেন। লূসিফরও তাদের সহিত খ্রীষ্টকে প্রণাম করল; কিন্তু তার হৃদয়ে ছিল এক অদ্ভূত, ভয়ংকর দ্বন্দ্ব । সত্য ও বাধ্যতা এবং ঈর্ষা ও হিংসার মধ্যে দ্বন্দ্ব চলছিল। মনে হচ্ছিল পবিত্র দূতগণের প্রভাব কিছু সময়ের জন্য তাকে (লূসিফর) প্রভাবিত করেছিল। যখন প্রশংসা গীতি উঠছিল, মনে হচ্ছিল যে মন্দ আত্মা পরাভূত হয়েছে; অনির্বচনীয় প্রেম তার সম্পূর্ণ দেহকে অভিভূত করে নিয়েছিল; নিষ্পাপ আরাধনাকারীদের সহিত একত্রিত ভাবে তার হৃদয়ের প্রেম পিতা ও পুত্রের প্রতি বর্ষিত হতে থাকল। কিন্তু পুনরায় কর্তৃত্বের আকাঙ্খা তার হৃদয়ে ফিরে এল, এবং খ্রীষ্টের প্রতি তার হিংসা প্রজ্জ্বলিত হয়ে উঠল । লূসিফরকে দত্ত উচ্চ সম্মান তাকে তার স্রষ্টার প্রতি কোনরূপ কৃতজ্ঞতা প্রদর্শনে অনুপ্রাণিত করল না। সে নিজ দীপ্তিতে গর্বিত হ'ল এবং ঈশ্বরের সমতুল্য হতে চাইল । দূতগণ তার নির্দেশ মান্য করতে আনন্দিত হ’ত এবং সে তাদের সকলের চেয়ে অধিক গৌরবে ভূষিত ছিল। শুধু মাত্র ঈশ্বরের পুত্র তার চেয়ে উন্নত ছিলেন। ক্ষমতাবান দূতগণ প্রশ্ন তুলল “কেন, খ্রীষ্ট কর্তৃত্ব করবেন?” PPBeng 13.1

লূসিফর দূতগণের মধ্যেও এই অসন্তুষ্টির মনোভাব ছড়াতে আরম্ভ করল । কিছু কালের জন্য সে তার আভ্যন্তরীণ উদ্দেশ্যকে ঈশ্বরের প্রতি সম্মান দ্বারা ঢেকে রাখল। যে সমস্ত আজ্ঞা ও নিয়মকানুন দ্বারা স্বর্গীয় দূতগণকে পরিচালিত করা হত, সেগুলির প্রতি সে সন্দেহের সৃষ্টি করতে আরম্ভ করল। সে ধারণা দিল যে ঐ সমস্ত প্রয়োজন নেই, কেননা তাদের নিজস্ব জ্ঞানই তাদের পরিচালনা করতে সক্ষম। তাদের সমস্ত চিন্তাই পবিত্র; আর যেমন ঈশ্বর পবিত্র ও কোন ভুল করেন না, সেই ভাবে তারাও ভুল করতে পারে না। ঈশ্বরের পুত্রকে ঈশ্বরের সমতুল্যরূপে উত্থাপিত করা লূসিফরের নিকট অন্যায় বলে মনে হলো। ঈশ্বরের পুত্রকে ঈশ্বরসম, পিতাসম গৌরব প্রদান লূসিফরের কাছে অন্যায় বিচার বলে বিবেচিত হয়েছিল। যদি দূতগণের এই রাজপুত্র তার সত্যিকার মহান সম্মানে ভূষিত হ'ত, তা হলে স্বর্গ নিবাসী প্রত্যেকেরই প্রভৃত কল্যাণ সাধিত হ'ত, কেননা তার লক্ষ্যই হল সকলের জন্য পূর্ণ স্বাধীনতা আনয়ন করা । লূসিফরের সূক্ষ্ম প্রতারণা স্বর্গীয় দরবারের সর্বত্র দ্রুত প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করতে শুরু করল । PPBeng 13.2

ঈশ্বরের পুত্রের সত্যিকারের অবস্থান প্রথম থেকেই একই ছিল । কিন্তু, অনেক দূতগণই লূসিফরের প্রতারণা দ্বারা অন্ধ হয়ে গেল। সে এত সুচতুর ভাবে তার নিজের অবিশ্বাস ও অসন্তুষ্টি তাদের মনে ঢুকিয়ে দিল যে তার দালালী উন্মোচন করা সম্ভব হলো না। মতভেদ ও অসন্তুষ্টি সৃষ্টি করার জন্য লূসিফর ঈশ্বরের উদ্দেশ্য সমূহকে এক ভ্রান্তিজনক আলোতে প্রকাশ করল। ঈশ্বরের প্রতি তার পূর্ণ বাধ্যতার দাবী করে, সে অনুরোধ করল যে স্থিতিশীলতার জন্যই স্বর্গীয় সরকারের কিছুটা পরিবর্তন প্রয়োজন । গোপনে মতভেদ ও বিদ্রোহ ছড়াতে থাকা সত্ত্বেও সে এমন ভান করল যে তার প্রকৃত উদ্দেশ্য হলো ঈশ্বরের প্রতি বাধ্যতার প্রচার করা এবং ঐক্য ও শান্তি রক্ষা করা। PPBeng 14.1

কোন বাহ্যিক প্রকাশ না হওয়া সত্ত্বেও অলক্ষ্যে দূতগণের মধ্যে বিভেদ ও মনোমালিন্য সৃষ্টি হতে শুরু করল। লূসিফরের পরোক্ষ ঈঙ্গিতের প্রতি অনেকে সহানুভূতিপূর্ণ মনোভাব ব্যক্ত করতে লাগলেন। তারা অসন্তুষ্ট ও অসুখী হলেন, এবং খ্রীষ্টকে সর্বোচ্চে উন্নীত করায় ঈশ্বরের যে উদ্দেশ্য তাতে তারা ক্ষুব্ধ হলেন। কিন্তু বাধ্য ও বিশ্বস্ত দূতগণ ঈশ্বরের আইনের যুক্তি ও ন্যায্যতা অনুধাবন করতে সক্ষম হলেন। খ্রীষ্ট ঈশ্বরের পুত্র ছিলেন এবং দূতগণ সৃষ্টির আগে হতেই ঈশ্বরের সহিত এক ছিলেন। তিনি চিরকালই পিতার দক্ষিণ পার্শ্বে ছিলেন। এখন কেন এই বৈসাদৃশ্যতা হবে? PPBeng 14.2

ঈশ্বর লূসিফরের প্রতি দীর্ঘকাল ধৈর্য ধরলেন। এই অসন্তুষ্টির মনোভাব একটি নূতন উপাদান ছিল, অদ্ভুত ও অবর্ণনীয় । লূসিফর নিজেও জানতে পারল না যে সে কোথায় ভেসে যাচ্ছে। অসীম প্রেম ও জ্ঞান দ্বারাই যা সম্ভব লূসিফরকে তার ভুল সংশোধনের জন্য সেই প্রচেষ্টা করা হল। তাকে দেখানো হ'ল যে এই বিদ্রোহের অন্তিম পরিণতি কি হতে পারে। PPBeng 14.3

লূসিফর বুঝতে পারল যে সে অন্যায় করছে। সে অনুধাবন করল যে, “সদাপ্রভু আপনার সমস্ত পথে ধৰ্ম্মশীল, আপনার সমস্ত কার্য্যে দয়াবান” (গীত- সংহিতা ১৪৫:১৭), সে বুঝতে পারল যে স্বর্গের আইন সকল ন্যায্য এবং তাকে সমস্ত স্বর্গ-নিবাসীদের সামনে ইহা স্বীকার করা প্রয়োজন। যদি সে তাই করত তাহলে সে নিজেকে এবং অনেক স্বর্গ দূতগণকে রক্ষা করতে পারত। যদি সে ঈশ্বরের নিকট প্রত্যাবর্তন করতে ইচ্ছুক হ'ত, আর যদি সে ঈশ্বরের নিজ পরিকল্পনায় তাকে যে স্থান দিয়েছেন তাতেই সন্তুষ্ট হতো, তাকে তার পুরাতন পদে পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করা হ'ত। অন্তিম সিদ্ধান্ত গ্রহণের সময় উপস্থিত হ'ল; তাকে স্বর্গীয় রাজার নিকট আত্ম-সমর্পণ করতে হবে, অথবা প্রকাশ্যে বিদ্রোহ ঘোষণা করতে হবে। সে আত্ম-সমর্পণের সিদ্ধান্ত প্রায় নিয়েই ফেলেছিল, কিন্তু গর্ব তার পথের বাধা হ'ল। সে এত উচ্চে অধিষ্ঠিত ছিল যে তার জন্য এটি স্বীকার করা যে সে অন্যায় করেছে তা তার কাছে অতি বড় একটি ত্যাগ বলে মনে হল । PPBeng 14.4

ঈশ্বরের ধৈর্যশীলতাকে লুসিফর স্বীয় উৎকর্ষতার পরিচায়করূপে, এবং বিশ্বের রাজা যে পরিশেষে তার শর্ত মেনে নেবেন ইহার প্রমাণ হিসাবে, চিহ্নিত করল। সে ঘোষণা করল যে যদি দূতগণ এখনও তার সাথে দৃঢ় ভাবে একাত্মতা ঘোষণা করেন তবে তারা যা কামনা করে সবই পাবে। সে তার স্রষ্টার বিরুদ্ধে মহা-সংঘাতে পরিপূর্ণ ভাবে আত্ম-নিয়োগ করল। এই ভাবে “আলোর বাহক” লূসিফর পরিণত হ'ল শয়তানে, সে হ'ল ঈশ্বরের “শত্রু” । PPBeng 15.1

বিশ্বস্ত দূতগণের অনুনয় বিনয় ঘৃণার সহিত প্রত্যাখ্যান করে সে তাদের প্রবঞ্চিত ক্রীতদাস বলে ধিক্কার দিল। সে আর কখনো খ্রীষ্টের আধিপত্য স্বীকার করে নেবে না। খ্রীষ্টকে দত্ত সম্মান সে নিজের জন্যই দাবী করতে সংকল্পবদ্ধ হ'ল । যারা তার দলে যোগ দেবে তাদের জন্য সে এমন এক নূতন ও উত্তম প্রশাসন ব্যবস্থার প্রতিজ্ঞা করল যার আওতায় সকলে পূর্ণ স্বাধীনতা উপভোগ করবে। অনেক দূতগণ তাকে তাদের নেতা বলে গ্রহণ করার সংকল্প ব্যক্ত করল। সে আশা পোষণ করল, যে সকল দূতগণ তার দলে যোগ দেবে, সে ঈশ্বরের সমতুল্য হবে এবং স্বর্গের সকলেই তার প্রতি বাধ্যতা প্রদর্শন করবে। PPBeng 15.2

তবুও ঈশ্বরের প্রতি বাধ্য দূতগণ তাকে এবং তার প্রতি সহানুভূতিশীল অন্যান্য দূতগণকে ঈশ্বরের নিকট আত্ম-সমর্পণ করতে অনুরোধ করল; যদি তারা আত্ম-সমর্পণে অস্বীকার করে তবে তার অনিবার্য পরিণতি কি হবে তাও তারা তাদের নিকট ব্যাখ্যা করল। তারা সকলকে সতর্ক করে দিল যেন তারা লূসিফরের ছলনাপূর্ণ যুক্তিতে কান না দেয় এবং তাকে ও তার অনুগামীদের ঈশ্বরের উপস্থিতি, তাঁর জ্ঞান ও ক্ষমতাকে প্রশ্ন করার ভুল স্বীকার করতে সনির্বন্ধ অনুরোধ জানালো । PPBeng 15.3

অনেকেই তাদের অবিশ্বস্ততার জন্য অনুতাপ করতে ও পিতা ও তাঁর পুত্রের আনুকুল্য লাভ করতে ইচ্ছুক ছিল । কিন্তু লূসিফর এখন ঘোষণা করল যে যারা তার সহিত একত্রিত হয়েছে তারা প্রত্যাবর্তনের পথ হতে অনেক দুরে সরে গিয়েছে; ঈশ্বর আর ক্ষমা করবেন না। সে স্বয়ং আর কখনো খ্রীষ্টের কর্তৃত্ব স্বীকার না করতে মনস্থ করল। একমাত্র যে পথ তাদের নিকট খোলা আছে তা হ'ল তাদের স্বাধীনতা বহাল রাখা এবং তাদেরকে যে অধিকার দেয়া হচ্ছে না তা বল পূর্বক অধিকার করে নেয়া । PPBeng 15.4