মেজের সম্মুখে সমবেত হইলে পর তিনি মর্ম্মভেদী দুঃখে দুঃখিত হইয়া কহিলেনঃ— “আমার দুঃখভোগের পুর্ব্বে তোমাদের সহিত আমি এই নিস্তার পর্ব্বের ভোজ ভোজন করিতে একান্তই বাঞ্ছা করিয়াছি ; কেননা আমি তোমাদিগকে বলিতেছি, যে পর্য্যন্ত ঈশ্বরের রাজ্যে ইহা পূর্ণ না হয়, সেই পর্য্যন্ত আমি ইহা আর ভোজন করিব না । পরে তিনি পানপাত্র গ্রহণ করিয়া ধন্যবাদ পূর্ব্বক কহিলেন, ইহা লও, এবং আপনাদের মধ্যে বিভাগ কর ; কেননা আমি তোমাদিগকে বলিতাছি, যে পর্য্যন্ত ঈশ্বরের রাজ্যের আগমন না হয়, এখন অবধি সে পর্য্যন্ত আমি দ্রাক্ষাফলের রস আর পান করিব না ।” (লূক ২২:১৫-১৮ ) । CCh 324.3
কিন্তু প্রভুর ভোজের অনুষ্ঠানটী একটী দুঃখের অনুষ্ঠান নহে । ইহার উদ্দেশ্য তাহা নহে । তাঁহার পবিত্র মেজের সম্মুখে উপস্থিত হইয়া প্রভুর শিষ্যগণের নিজ নিজ ত্রুটী-বিচ্যুতি স্মরণ করিয়া বিলাপ করিতে হইবে না । তাহাদের বিগত ধর্ম্ম-অভিজ্ঞতা উন্নত হউক, কিংবা অনুন্নত হউক, তৎসম্বন্ধে তাহাদের আলোচনা করিতে হইবে না । তাহাদের নিজেদের ও তাহাদের ভ্রাত্রিগণের মধ্যে যে বিবাদ-বিসংবাদ উপস্থিত হইয়াছিল, তাহা আর স্মরণে আনিতে হইবে না । কারণ প্রস্তুত হওনের বা পাদ-প্রক্ষালনের বিধি পালনের সময়ে ইহার সকলই সমাধা করা হইয়াছে । আত্ম-পরীক্ষা ও বিবাদ-বিসংবাদ মিটান, এ সকলই নিষপন্ন করা হইয়াছে । CCh 325.1
এক্ষণে তাহারা খ্রীষ্টের সহিত সাক্ষাৎ করিবার জন্য আসিয়াছে । সুতরাং এক্ষণে তাহাদের আর ক্রুশের ছায়াতলে দণ্ডায়মান থাকিবার প্রয়োজন নাই ; কেননা তাহারা এক্ষণে ক্রুশের রক্ষাকারী জ্যোতির মধ্যে অবস্থান করিতেছে । ধার্ম্মিকতা-সূর্য্যের উজজ্বল কিরণের নিকটে এক্ষণে তাহাদের প্রাণ খুলিয়া দিতে হইবে । খ্রীষ্টের বহুমূল্য রক্তের গূণে পরিষ্কৃত হৃদয়গুলিতে তিনি অদৃশ্য ভাবে বসবাস করিয়া কহিতেছেনঃ— “শান্তি আমি তোমাদের কাছে রাখিয়া যাইতেছি, আমারই শান্তি তোমাদিগকে দান করিতেছি ; জগৎ যেরূপ দান করে, আমি সেরূপ দান করি না ; (যোহন ১৪:২৭ ।) এই কথা তাহাদের শুনিতে হইবে । CCh 325.2
খ্রীষ্টের ভগ্ন দেহের ও পাতিত রক্তের নিদর্শন স্বরূপ রুটী ও দ্রাক্ষারস গ্রহণ করিবার সময়ে আমরা কল্পনাবলে উপরিস্থ কুঠুরিতে পবিত্র প্রভুর ভোজে যোগদান করিয়া থাকি । যিনি জগতের পাপভার লইয়া গিয়াছেন, তাঁহার যন্ত্রণা দ্বারা উৎসর্গীকৃত উদ্যানের মধ্য দিয়া আমরা যেন যাইতে থাকি । যে মহা সংগ্রামের দ্বারা ঈশ্বরের সহিত আমাদের পুনর্ম্মিলন ঘটিয়াছিল, আমরা যেন তাহা স্বচক্ষে দেখিতে থাকি । আমরা খ্রীষ্টকে আমাদের মধ্যে যেন ক্রুশে-বিদ্ধ দেখিতে থাকি । CCh 325.3
ক্রুশে বিদ্ধ মুক্তিদাতার দিকে দৃষ্টিপাত করিলে স্বর্গের রাজরাজেশ্বর আমাদের জন্য যে আশ্চর্য্য বলি উৎসর্গ করিয়াছেন, তাহার মর্ম্ম ও গুরুত্ব অধিকতর সুস্পষ্টরূপে করিতে পারিব । পরিত্রাণ কল্পনা আমাদের সম্মুখে উজজ্বল হইয়া উঠিবে, কালভেরীর চিন্তা আমাদের হৃদয়ের মধ্যে জীবিত ও পবিত্র আবেগ জাগাইয়া তুলিবে । আমাদের হৃদয়ে ও ওষ্ঠে ঈশ্বরের ও মেষশাবকের প্রশংসা-ধ্ব্নি উত্থিত হইতে থাকিবে ; কারণ যে ব্যক্তি কালভেরির দৃশ্য নূতন ভাবে স্মৃতি-পটে অঙ্কিত করিতে পারিবে তাহার মনে অহংকার কিংবা আত্ম-প্রীতি স্থান পাইবে না । CCh 326.1
বিশ্বাসনেত্রে খ্রীষ্টের মহা বলিদান সন্দর্শন করিলে আত্মা খ্রীষ্টের আধ্যাত্মিক জীবনের সদৃশ হয় । আর ঐ আত্মা প্রত্যেকটী প্রভুর ভোজে আধ্যাত্মিক শক্তি লাভ করে । এই অনুষ্ঠানটী এমন একটী জীবন্ত সম্বন্ধ স্থাপন করে, যদ্দ্বারা বিশ্বাসী খ্রীষ্টের সহিত আবদ্ধ হইয়া পরে পিতার সহিত আবদ্ধ হয় । বিশেষ অর্থে—ইহা ঈশ্বর ও তাঁহাতে নির্ভরশীল মানবের মধ্যে এক সম্বন্ধ স্থাপন করে । CCh 326.2
প্রভুর ভোজের অনুষ্ঠানটী খ্রীষ্টের দ্বিতীয় আগমন নির্দ্দেশ করে । শিষ্যগণের মনে এই আশাটী যেন সুস্পষ্টরূপে জাগরুক থাকে, তজজন্যই এই বিধানটী দত্ত হইয়াছিল । তাঁহার মৃত্যু স্মরণার্থে যখনই তাঁহারা সমবেত হইতেন, তখনই তাঁহারা এই কথা স্মরণ করিতেন যে— “তিনি পানপাত্র লইয়া ধন্যবাদপূর্ব্বক তাঁহাদিগকে দিয়া কহিলেন, তোমরা সকলে ইহা হইতে পান কর ; কারণ ইহা আমার রক্ত, নূতন নিয়য়ের রক্ত, যাহা অনেকের জন্য, পাপ মোচনের নিমিত্ত, পাতিত হয় । আর আমি তোমাদিগকে কহিতেছি, এখন অবধি আমি এই দ্রাক্ষাফলের রস আর কখনও পান করিব না, সেই দিন পর্য্যন্ত, যখন আমি আপন পিতার রাজ্যে তোমাদের সঙ্গে ইহা নূতন পান করিব ।” (মথি ২৬:২৭-২৯ ।) তাঁহাদের প্রভুর আগমনের প্রত্যাশায় তাড়না ও ক্লেশের মধ্যেও তাঁহারা সান্ত্বনা প্রাপ্ত হইতেন । “যতবার তোমরা এই রুটী ভোজন কর, ও এই পানপাত্রে পান কর, তত বার প্রভুর মৃত্যু প্রচার করিয়া থাক, যে পর্য্যন্ত তিনি না আইসেন ।” (১ করি ১১:২৬ ।) —এই চিন্তা তাঁহাদের পক্ষে এত বহুমূল্য ছিল যে, তাহা ভাষায় বর্ণনা করা অসাধ্য । CCh 326.3
এই সকল বিষয় আমাদের কখনও বিস্মৃত হওয়া উচিত নহে । যীশুর যে প্রেম আমদিগকে বশে রাখিয়া চালাইতেছে,তাহা সর্ব্বদা আমাদের স্মৃতিপটে জাগরূক রাখিতে হইবে । ঈশ্বর আমাদের জন্য যে অপার প্রেম প্রদর্শন করিয়াছেন, তাহা আমাদের স্মৃতিপটে জাগরিত করিবার নিমিত্ত খ্রীষ্ট এই বিধিটী স্থাপন করিয়াছিলেন । খ্রীষ্টের মাধ্যম ভিন্ন অন্য কোন উপায়ে ঈশ্বরের ও আমাদের আত্মার মধ্যে মিলন স্থাপিত হইতে পারে না । যীশুর প্রেমের দ্বারা ভ্রাতায় ভ্রাতায় মিলন সুদৃঢ় ও প্রেম চিরতরে স্থাপিত হওয়া আবশ্যক । আর খ্রীষ্টের মৃত্যু ব্যতীত তাঁহার প্রেম আমাদের পক্ষে ফলোৎপাদক হইতে পারে না । এক মাত্র তাঁহার মৃত্যুর নিমিত্তই আমরা সানন্দে তাঁহার আগমনের অপেক্ষায় থাকিতে পারি । তাঁহার মহা বলিদানই আমাদের একমাত্র আশাস্থল । ইহার উপরেই আমাদের বিশ্বাস অটল রাখিতে হইবে । CCh 327.1