যােষেফ অথবা দানিয়েলের চেয়ে বয়সে ছােট মােশি, যখন তিনি শিশুকালে গৃহের সতর্ক দৃষ্টি, তত্ত্বাবধান এবং গৃহবাস হতে বের হলেন; যােষেফ এবং দানিয়েলের মত তার জীবনও একইভাবে গঠিত হয়েছিল । তিনি কেবল বারাে বৎসর পর্যন্ত তার ইব্রীয় আত্মীস্বজনদের সঙ্গে যাপন করেছেন, তথাপি এই বৎসরগুলােতেই তার মহত্বের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপিত হয়েছিল; আর এই ভিত্তি স্থাপিত হয় এমন একটি হাত দ্বারা, যা জনসাধারণের পরিচিত এবং খ্যাতিসম্পন্ন ছিল না। EdBen 56.1
যােকেব ছিলেন একজন ক্রিতদাসী। নিচু ও নিরহঙ্কার তার জীবন, তার বােঝা ছিল অত্যন্ত ভারি। কিন্তু এক নাসারৎ নগরের মরিয়ম ব্যতিরেকে আর অন্য কোন স্ত্রীলােকের মাধ্যমে জগৎ মহর আশীর্বাদ লাভ করতে পারে নি। তিনি যখন বুঝতে পারলেন যে, তার সন্তান শীঘ্র তার তত্ত্বাবধান ছেড়ে যাবে এবং তার সন্তানটিকে এমন লােকদের তত্ত্বাবধানে চলে যেতে হবে যারা ঈশ্বরকে জানে না, তখন তিনি একান্তভাবে তার আত্মাকে স্বর্গের সঙ্গ সংযুক্ত করতে চেষ্টা করলেন। তিনি তার অন্তঃকরণে ঈশ্বর প্রেম এবং ভক্তির বীজ রােপণ করলেন। এভাবে বিশ্বস্ততার সঙ্গে কাজ শেষ করা হল। সত্যের ঐ সব নীতিমালা মােশির মূল শিক্ষার কাছে। বােঝাস্বরূপ হলেও কোন প্রভাবের কারণে তিনি তা ত্যাগ করেন নি। EdBen 56.2
গােশন প্রদেশের দরিদ্র পরিবারের যােকেবদের ছেলেকে রাজপ্রাসাদে, মিস্ত্রীয় রাজকুমারী তার প্রিয় সন্তান হিসেবে গ্রহণ করলেন। মােশি সর্বোচ্চ পৌর এবং সামরিক শিক্ষা লাভ করেছিলেন। মহান ব্যক্তিত্ব, আকর্ষণীয় চেহারা, উন্নত মন ও রাজকীয় আচরণ, এবং খ্যাতনামা সামরিক নেতা, এ সবে তিনি জাতির গর্ব। মিসর-রাজ ও পুরােহিত গােষ্ঠীর একজন সদস্য ছিলেন, যদিও মােশি প্রতিমাপূজা অস্বীকার করেছেন তথাপি তিনি মিস্ত্রীয়দের ধর্মের সমস্ত নিগূঢ় বিষয়ে জ্ঞান অর্জন করেছিলেন। এ সময় মিসর ছিল অতিশয় শক্তিশালী দেশ এবং সভ্যতার জগতে মিসরের স্থান ছিল সর্ব উচ্চে আর মােশি প্রত্যাশিত সার্বভৌম অধিপতি, সর্ববিশ্বের সর্বশ্রেষ্ঠ সম্মানের অধিকারী ছিলেন। তথাপি তার মনােনয়নটি সর্বশ্রেষ্ঠ। ঈশ্বরের সমাদরার্থে এবং তার দলিত লােকদের মুক্তির লক্ষ্যে মােশি মিশরের সমস্ত সম্মান বিসর্জন দিলেন। অতঃপর একটি বিশেষ উপায়ে তার প্রশিক্ষণের ভার ঈশ্বর স্বহস্তে তুলে নিলেন । EdBen 56.3
মােশি এখনও তার কর্মজীবনের জন্য প্রস্তুতি গ্রহণ করতে পারেন নি। তাকে এখন ঐশ্বরিক ক্ষমতায় নির্ভরশীল হতে শিক্ষা করতে হবে। তিনি ঈশ্বরের উদ্দেশের ভুল বুঝেছিলেন। তিনি আশা করেছিলেন, সৈন্য সামন্ত দ্বারা ইস্রায়েলকে মুক্ত করবেন। এই জন্য তিনি সকল বিপদের ঝুঁকি মাথায় নিলেন, এবং ব্যর্থ হলেন। তার পরাজয় ও নিরুৎসাহের কারণে, তিনি অপরিচিত একটি দেশে একজন পলাতক এবং প্রবাসী হলেন। EdBen 57.1
মােশি মিদিয়ােনের প্রান্তরে চল্লিশ বছর যাবৎ মেষ চরালেন । ঘটনাক্রমে যদিও তিনি তার জীবনের উদ্দেশ্য হতে বিচ্ছিন্ন, তথাপি তার পূর্ণতা লাভের জন্য তার যে শৃঙ্খলা শিক্ষার আবশ্যক ছিল, তা তিনি পাচ্ছিলেন। আত্ম-সংযমের মধ্য দিয়ে এক অশিক্ষিত এবং উচহুঙ্খল জনতাকে শাসন করার জন্য তাকে অবশ্যই জ্ঞান অর্জন করতে হবে। মেষ ও মেষশাবকদের তত্ত্বাবধানের মধ্যেই তাকে এমন অভিজ্ঞতা অর্জন করতে হবে, যা তাকে ইস্রায়েলের প্রতি একজন বিশ্বস্ত, দীর্ঘসহিষ্ণু মেষ পালক হিসেবে গঠন করবে। তিনি যাতে ঈশ্বরের একজন প্রতিনিধি হতে পারেন, সে জন্য তাকে তার নিকট থেকে শিক্ষা লাভ করতে হবে। EdBen 57.2
মিশরে যে প্রভাবগুলাে তাকে ঘিরে রেখেছিল, তার ধাত্রী ও জননীর স্নেহ-ভালােবাসা, রাজার নাতি হিসেবে তার নিজের অবস্থা, বিলাসিতা এবং অনৈতিকতা, যা হাজার উপায়ে লােভ দেখিয়েছিল; সংস্কৃতির অতিশয্য, চাতুর্য, মিথ্যা ধর্মের এক ইন্দ্রিয়াসক্তি এ সব তার মন, এবং চরিত্রের ওপরে ছাপ এঁকে দিয়েছিল। প্রান্তরের অনমনীয় সরলতায় সকলই অদৃশ্য হয়ে গেল। EdBen 57.3
পর্বতের নিঃসঙ্গতার গুরুগম্ভীর মহত্ত্বের মাঝে, মােশি একাকী ঈশ্বরের সঙ্গে ছিলেন। সব জায়গায় স্রষ্টার নাম লেখা ছিল। মােশি ঈশ্বরের সান্নিধ্যে দাঁড়িয়ে থাকতেন এবং তার শক্তি, তাঁর ক্ষমতা তাকে ছায়া করে থাকত। এই স্থানে তার স্বয়ং সম্পূর্ণতা বিদূরীত হয়ে যেত । অসীমের সান্নিধ্যে থেকে তিনি উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন, মানুষ কত। দুর্বল কত অক্ষম, কত অদূরদর্শী। EdBen 57.4
এখানে মােশি, এমন কিছু লাভ করলেন যা কঠোর শ্রমসাধ্য এবং দুশ্চিন্তা-পীড়িত জীবনে তার সহবর্তী ছিল- ঈশ্বরের ব্যক্তিগত উপস্থিতি বােধ। খ্রীষ্ট কেবল মাংসে মূর্তিমান হবেন, মােশি কেবল তাই লক্ষ করেন নি, তিনি দেখলেন, খ্রীষ্ট সমগ্র যাত্রাপথে ইস্রায়েলের সঙ্গে সঙ্গে ছিলেন। যখন মােশিকে ভুল বােঝা হচ্ছিল, যখন তারা তাদের মিথ্যা পরিচয় দিয়েছিল, যখন তাকে গ্লানি এবং অপমান সহ্য করতে হয়েছিল, যখন বিপদ এবং মৃত্যুর মুখােমুখি হতে হয়েছিল, তখন তিনি যেন “তাঁহাকে দেখিয়াই স্থির থাকিলেন।” ইব্রীয় ১১:২৭। EdBen 57.5
মােশি কেবল ঈশ্বরের বিষয় চিন্তাই করেন নি, তিনি তাঁকে দেখেছিলেন। তিনি সব সময় ঈশ্বরকে তার সামনে দেখতেন। তিনি কখনাে ঈশ্বরের মুখমণ্ডল হতে দৃষ্টিহারা হন নি। EdBen 58.1
মোশির কাছে বিশ্বাস কোন অনুমান ছিল না, এটি ছিল একটি বাস্তব বিষয়। তিনি বিশ্বাস করতেন যে, ঈশ্বর তার জীবনকে নিয়ন্ত্রণ করছেন এবং সব সময়ে তিনি তাঁকে স্বীকার করেছেন। EdBen 58.2
তার ওপরে যে মহান দায়িত্ব দেয়া হয়েছিল, তাতে তিনি কৃতকার্যতা লাভের জন্য ঐশ্বরিক শক্তির ওপর নির্ভর করেছিলেন। তিনি উপলব্ধি করতে পারলেন যে, তার সাহায্যের প্রয়ােজন, তিনি তা যাচা করলেন, তিনি বিশ্বাসে তা আঁকড়ে ধরলেন, এবং শক্তি লাভের নিশ্চয়তা নিয়ে তিনি সামনের দিকে এগিয়ে গেলেন। EdBen 58.3
প্রান্তরে চল্লিশ বছরের প্রশিক্ষণের দ্বারা মােশি এইরূপ অভিজ্ঞতা অর্জন করলেন। এমন মহান অভিজ্ঞতা, অসীম জ্ঞানের বিষয় অন্যের সঙ্গে সহভাগ করার সময় তিনি সুদীর্ঘ সময় বা এর মূল্যমান খুব বেশি- একথা ভাবলেন না। অন্যকেও এই অভিজ্ঞতার সহভাগি করার বিষয়টি অসীম জ্ঞান অতিশয় দীর্ঘ সময় সাপেক্ষ এবং এর মূল্য মহান বলে গণনা করলেন না। EdBen 58.4
প্রশিক্ষণ ও পাঠ্যসূচি শিক্ষা কেবল ইস্রায়েলের ইতিহাসেই নয়, কিন্তু যারা সেই কাল হতে আরম্ভ করে এই কাল পর্যন্ত পৃথিবীর উন্নতির কথা বলেছে, তাদের সঙ্গেও তা রয়েছে। মােশির মহত্বের সর্বশ্রেষ্ঠ সাক্ষ্য, অনুপ্রাণিত বাক্য দ্বারা আনিত তার জীবনের উপরে বিচার এই, “মােশির তুল্য কোন ভাববাদী ইস্রায়েলের মধ্যে আর উৎপন্ন হয় নাই, সদাপ্রভু তাহার সঙ্গে সম্মুখসম্মুখি হইয়া আলাপ করিতেন।” দ্বিতীয় বিবরণ ৩৪:১০। EdBen 58.5