আমি ঈশ্বরের প্রজাবৃন্দকে মহাপরাক্রমে বিকম্পিত হইতে দেখিলাম । তাহাদের মধ্যে কেহ কেহ দৃঢ় বিশ্বাস সহকারে তীব্র রোদন করিতে করিতে ঈশ্বরের নিকট কাকুতি-মিনতি করিতেছে । CCh 654.1
আমি দেখিলাম কেহ কেহ আকুল প্রাণে কাকুতি-মিনতিতে যোগ দিল না । তাহাদিগকে দেখিয়া উদাসীন ও অমনোযোগী বলিয়া মনে হইল । তাহারা তাহাদের চতুষ্পার্শ্বস্থ অন্ধকার প্রতিরোধ না করায়, উহা তাহাদিগকে ঘন মেঘের ন্যায় পরিবৃত করিল । আমি দেখিলাম ঈশ্বরের দূতগণ এইরূপ লোকদিগকে পরিত্যাগ করিয়া যাঁহারা শয়তানের দূতগণের প্রতিরোধার্থে যথাসাধ্য চেষ্টা করিতেছেন, এবং একান্ত মনে ঈশ্বরকে ডাকিয়া আত্ম-রক্ষার্থে প্রয়াস পাইতেছেন, তাঁহাদের সাহায্যের জন্য তাঁহাদের নিকট ছুটিয়া যাইতেছেন । কিন্তু যাহারা শয়তানের হস্ত হইতে নিষ্কৃতি লাভের জন্য নিজেরা সাধ্যমত চেষ্টা করিতে পারাঙমুখ হইল, স্বর্গ দূতেরা সেই লোকদিগকে পরিত্যাগ করিয়া চলিয়া গেলেন, এবং আমি তাহাদিগকে আর দেখিতে পাইলাম না । প্রার্থনাকারীগণ ব্যাকুল প্রাণে ক্রন্দন করিতে থাকিলে, কখন কখন যীশুর নিকট হইতে এক জ্যোতিরেখা আসিয়া তাহাদের হৃদয় উৎসাহিত ও তাহাদের মুখমণ্ডল উদ্দীপিত করিত । CCh 654.2
পরে আমি চালন-ব্যাপারের ভাবার্থ জিজ্ঞাসা করায় অবগত হইলাম যে, লায়দিকেয়াদিগের নিকট বিশ্বস্ত সাক্ষীর স্পষ্ট সাক্ষ্য দেওয়াতেই এইরূপ ঘটনা ঘটিয়াছে । এইরূপ স্পষ্ট সাক্ষ্য গ্রহীতার অন্তরে ফলবতী হইবে এবং ইহা তাহাকে ধর্ম্ম-আদর্শ তুলিয়া ধরিতে ও সরল সত্য প্রকাশ করিতে পরিচালিত করিবে । কিন্তু কেহ কেহ এরূপ স্পষ্ট সাক্ষ্য একেবারেই সহ্য করিবে না । কাজেই তাহারা তাহার বিরুদ্ধে উঠিবে, ফলে ঈশ্বরের লোকদের মধ্যে এক কম্পন ক্রিয়া সম্পাদিত হইবে । CCh 654.3
আমি দেখিলাম যে, লোকে বিশ্বস্ত সাক্ষীর সাক্ষ্য অর্দ্ধমাত্রাও গ্রাহ্য করে নাই । যে পবিত্র ও যথার্থ সাক্ষ্যের উপরে মণ্ডলীর পরিণাম নির্ভর করে, তাহা তাচ্ছল্যের সহিত অবজ্ঞাত হইয়াছে, এমন কি একেবারেই অগ্রাহ্য করা হইয়াছে । সুতরাং এই সাক্ষ্য অবশ্যই অন্তরে গভীর অনুতাপ উপস্থিত করিবে এবং যাহারা প্রকৃত ভাবে এই সাক্ষ্য গ্রহণ করিবে, তাহারা উহা পালন করিবে ও পবিত্রীকৃত হইবে । CCh 654.4
দূত আমাকে কহিলেন, “ঐ শুন” । পরক্ষণেই নানা প্রকার বিভিন্ন বাদ্যযন্ত্রের ঐক্যতান বিশিষ্ট সুমধুর ধ্বনি আমার কর্ণকুহরে প্রবেশ করিল । তেমন সুমধুর ধ্বনি আমি আর কখনও শ্রবণ করি নাই । সে তান সে ধ্বনি করুণামাখা, সহানুভূতি ও উল্লাসপূর্ণ পবিত্র আনন্দ বলিয়াই আমার প্রতীয়মান হইল । তখন আমি সত্যই আনন্দে বিভোর হইয়া উঠিলাম । দূত কহিলেন, “চাহিয়া দেখ” তাহাতে মহাপরাক্রমে বিকম্পিত যে দলকে আমি পূর্ব্বে দেখিয়াছিলাম, সেই দলের প্রতি পুনরায় আমার মনোযোগ আকৃষ্ট হইল । যাহাদিগকে আমি পূর্ব্বে আত্মিক যাতনার সহিত সকরুণ প্রার্থনা করিতে দেখিয়াছিলাম, তাহারাই এক্ষণে পুনরায় আমার দৃষ্টিপথে পতিত হইল । আমি দেখিলাম তাহাদের আপাদ-মস্তক বর্স্মাবৃত ও তাহাদের চতুর্দ্দিকে রক্ষাকারীদূতের সংখ্যা পুর্ব্বাপেক্ষা দ্বিগুণ । সৈন্য শ্রেনীর ন্যায় তাহারা শৃঙ্খলার সহিত অগ্রসর হইতেছিল । তাহাদের কি মর্ম্মভেদী যাতনার মধ্য দিয়া যাইতে হইয়াছিল ও যে কী কঠোর প্রতিদ্বন্দ্বিতা সহ্য করিতে হইয়া ছিল, তাহা তাহাদের মুখমণ্ডল দেখিয়াই বেশ উপলব্ধি হইতেছিল । তথাপি তাহদের মানসিক উদ্বেগ সূচিত মুখমণ্ডল এক্ষণে স্বর্গীয় জ্যোতিতে জ্যোতির্ম্ময় হইয়া উঠিল । তাহারা জয়লাভ করিতে পারিয়াছিল বলিয়া তাহাদের হৃদয় এক্ষণে মহা কৃতজ্ঞতায়, পবিত্র ও পূত আনন্দে পরিপূর্ণ হইল । CCh 655.1
এই দলের লোকসংখ্যা হ্রাস পাইয়াছিল, কেননা কম্পন হেতু অনেকে পথেই দল হইতে স্থলিত হইয়াছিল । (প্রকাশিত ৩:১৫-১৭ দ্রষ্টব্য) যাহারা অবহেলা ও অমনোযোগিতা বশতঃ পরিত্রাণার্থী ও জয় লাভেচ্ছুদিগের সহিত অবিরত প্রার্থনা ও কাকুতি-মিনতিতে যোগদান করে নাই, তাহারা বিজয়ীর পুরস্কার হইতে বঞ্চিত হইয়া অন্ধকারে পরি- ত্যক্ত হইল এবং শীঘ্রই অপর লোকে সত্য গ্রহণ করিয়া তাহাদের স্থান পূরণ করিল । শয়তানের দূতগণ এই নূতন দলের প্রতিরোধ করিতে চেষ্টা পাইল বটে, কিন্তু কৃতকার্য্য হইতে পারিল না । (ইফিষীয় ৬:১২-১৮) । CCh 655.2
তৎপরে সেই বর্স্মাবৃত লোকদিগকে আমি মহাশক্তিতে সত্য ঘোষণা করিতে শুনিলাম ; সঙ্গে সঙ্গে তাহাদের কার্য্যের ফলও দেখিলাম । যাহারা নানা প্রকার বাধাবিঘ্নের মধ্যে ছিল, আমি তাহাদিগকে দেখিতে পাইলাম ; দেখিলাম কোন কোন স্ত্রী তাহাদের স্বামীর জন্য, ও কোন কোন সন্তানসন্ততি তাহাদের মাতাপিতার জন্য সত্য গ্রহণ করিতে পারিতেছিল না । যে সকল সৎলোক পূর্ব্বে সত্য শ্রবণ করিতে ও গ্রহণ করিতে নিবারিত হইয়াছিল, এক্ষণে তাহারা আগ্রহ সহকারে সত্য গ্রহণ করিতে লাগিল । আত্মীয় স্বজনের ভয়ে আর তাহারা ভীত হইল না, সে সকল ভয় তাহাদের মন হইতে চলিয়া গেল । তাহাদের নিকট একমাত্র সত্যই তখন গৌরবের বিষয় বলিয়া বোধ হইল । এইরূপে সত্য পিপাসা তাহাদের নিকট এতই বলবর্তী হইয়া উঠিল যে, আপন আপন জীবন অপেক্ষা সত্য বহুমূল্য জ্ঞান করিতে লাগিল । আমি এই মহাপরিবর্ত্তনের কারণ জিজ্ঞাসা করায় দূত কহিলেন, ইহা ঈশ্বর প্রদত্ত তাপশান্তি, ইহা তৃতীয় দূতের উচ্চরব ।” CCh 656.1
ঈশ্বরের এই মনোনীত লোকদের সঙ্গে এক মহাশক্তি সংযুক্ত ছিল । দূত কহিলেন, “দৃষ্টিপাত কর ।” তাহাতে দৃষ্ট ও অবিশ্বাসীদিগের আমার মনোযোগ আকৃষ্ট হইল । দেখিলাম দুস্তেরা ব্যতিব্যস্ত হইয়া পড়িয়াছে । ঈশ্বরের লোকদের ক্ষমতা ও উৎসাহ দেখিতে পাইয়া তাহারা উত্তেজিত ও ক্রুদ্ধ হইয়া উঠিয়াছে । ফলে চারিদিকে মহা গণ্ডগোল উপস্থিত হইয়াছে । ঈশ্বরের আলোক ও ক্ষমতাপ্রাপ্ত সেই দলের বিরুদ্ধে অপর লোকেরা নানারূপ চক্রান্ত করিতেছে । গাঢ় অন্ধকারে পরিবৃত হইলেও তাহারা ঈশ্বরে নির্ভর করিয়া তাঁহারই অনুমোদিত পথে অবিচলিত চিত্তে দাঁড়াইয়া রহিল । আমি তাহাদিগকে কিংকর্ত্তব্যবিমূর দেখিলাম । পরে আমি তাহাদিগকে ঈশ্বরের নিকটে সনির্ব্বন্ধ প্রার্থনা করিতে শ্রবণ করিলাম ; তাহারা দিবানিশি অবিশ্রান্তরূপে ক্রন্দন করিতেছিল । (লূক ১৮:৭,৮ ; প্রকা ১৪:১৪,১৫) । CCh 656.2
আমি তাহাদিগকে এই কথা বলিতে শুনিলাম,— “হে ঈশ্বর, আপনার ইচ্ছাই সাধিত হউক ! আপনার লোকেরা রক্ষা পাইলে যদি আপনার গৌরব হয়, তাহা হইলে তাহাদিগকে রক্ষা করিবের জন্য পথ খুলিয়া দিউন ! আমাদের চতুষ্পার্শ্বস্থ পরজাতিগণের হস্ত হইতে আমাদিগকে মুক্ত করুন । তাহারা আমাদিগকে হত্যা করিতে দৃঢ়-সঙ্কল্প হইয়াছে ; কিন্তু একমাত্র আপনিই আমাদিগকে উদ্ধার করিতে পারেন ।” এই কয়েকটী কথাই আমার স্মরণে আসিতেছে । তাহাদিগকে দেখিয়া আমার মনে হইল যে, তাহারা সকলেই নিজেদিগকে অনুপযুক্ত বলিয়া ধারণা করতঃ ঈশ্বরের ইচ্ছার উপর সম্পূর্ণ বশ্যতা স্বীকার করিতেছে । তথাপি যাকোবের ন্যায় মুক্তি পাইবার আশায় প্রত্যেকেই একান্ত আকুলতার সহিত প্রার্থনায় মল্লযুদ্ধ করিতেছিল । CCh 657.1
তাহারা এইরূপে এইরূপে ব্যগ্র আর্ত্তনাদ আরম্ভ করিলে, দূতেরা সহানুভূতি প্রকাশ করতঃ তাহাদিগকে মুক্ত করিবার জন্য তথায় যাইতে ইচ্ছা প্রকাশ করিলেন । কিন্তু তাঁহাদের অধিনায়ক এক দীর্ঘকায় দূত তাঁহাদিগকে বাঁধা দিয়া কহিলেন, “ঈশ্বরের ইচ্ছা এখনও পূর্ণ হয় নাই । তাঁহাদিগকে সেই পানপাত্র হইতে পান করিতে হইবে । তাহাদিগকে ক্লেশে পরীক্ষা-সিদ্ধ হইতে হইবে ।” CCh 657.2
শীঘ্রই আমি ঈশ্বরের রব শুনিতে পাইলাম, তাহাতে আকাশমণ্ডল ও পৃথিবী কম্পিত হইল । (যোয়েল ৩:১৬ ; ইব্রীয় ১২:২৬ ; প্রকাশিত ১৬:১৭ পদ দ্রষ্টব্য) সেই সময়ে এক মহা ভুমিকম্প হইল, তাহাতে চারিদিকের প্রাসাদ সমূহ কাঁপিতে কাঁপিতে ভূমিস্যাৎ হইল । পরে আমি জয়োল্লাসের সুস্পষ্ট এক মধুর উচ্চধ্বনি শ্রবণ করিলাম । অত্যল্পকাল পুর্ব্বে যাহারা অধীনতাপাশে আবদ্ধ থাকিয়া দুঃখ কষ্টে নিপীড়িত হলিতেছিল, সেই দলকে এক্ষণে আমি বন্ধনমুক্ত অবস্থায় দেখিতে পাইলাম । এক উজজ্বল আলোক তাহাদের উপর শোভা পাইতেছিল । আহা ! তখন তাহাদিগকে দেখিতে কতই না সুন্দর দেখাইতেছিল ! ভাবনা ও ক্লান্তির ছায়া দূরীভূত হইয়া তাহাদের প্রত্যেকের মুখমণ্ডলে তখন স্বাস্থ্য ও সৌন্দর্য্য ফুটিয়া উঠিতেছিল । আর তাহাদের শত্রুগণ— তাহাদের চতুস্পার্শ্বস্থ অধার্ম্মিকগণ মৃত লোকদিগের ন্যায় ভূ-পতিত হইল, কেননা মুক্তি-প্রাপ্ত সাধুদিগের উপরে যে আলোক শোভা পাইতেছিল, সে আলোকের উজজ্বলতা তাহারা সহ্য করিতে পারিল CCh 657.3
না । CCh 658.1
প্রভু যীশুকে যে পর্য্যন্ত না আকাশীয় মেঘরথে দেখা গেল এবং বিশ্বস্ত ও পরীক্ষাসিদ্ধ দলটী যে পর্য্যন্ত না মুহূর্ত্তের মধ্যে ও চক্ষুর পলকে রূপান্তরিত হইয়া উজজ্বল হইতে উজজ্বলতর হইল, তাবৎ এই আলোক ও ইহার গৌরবচ্ছটা তাহাদের উপরে অবস্থিতি করিল । তখন কবর সকল খুলিয়া গেল, এবং সাধুগণ অমরত্ব পরিহিত হইয়া “মৃত্যু ও সমাধির উপরে জয়লাভ হইল” বলিয়া জয়ধ্বনি করিতে করিতে কবর হইতে বাহির হইয়া আসিল । এইরূপে তাহারা জীবিত ধার্ম্মিকগণের সহিত একযোগে আকাশে প্রভুর সহিত সাক্ষাৎ করিতে নীত হইল, আর তখন প্রত্যেক অমর কণ্ঠ হইতে গৌরব ও জয়োল্লাসধ্বনি শ্রুত হইতে লাগিল । CCh 658.2