“যেমন তাহারা তাহাদের জ্ঞানের ভুবনে ঈশ্বরকে গ্রহণ করিতে অস্বীকার করিল,
তাহাদের অচেতন হৃদয়ও অন্ধকারাচ্ছন্ন হইয়া পড়িল।”
যদিও আমাদের আদি পিতা-মাতাকে নিস্পাপ এবং পবিত্র করে সৃষ্টি করা হয়েছিল, তবুও তারা যে কখনাে ভুল করবেন না এমন নয়। ঈশ্বর তাদের এমন করে সৃষ্টি করতে পারতেন যে, তারা ঈশ্বরের আজ্ঞা লঙ্ঘন করবে না; কিন্তু তাহলে তাদের চরিত্রের কোনই বিকাশ লাভ হত না ; তারা স্বেচ্ছায় ঈশ্বরের সেবা করতেন না, এবং তা হত তাদের কাছে বাধ্যতামূলক সেবা। এই কারণে তিনি তাদের মনােনয়ন শক্তি দিলেন- হয় তারা স্বেচ্ছায় তার আজ্ঞাবহ হবে, অথবা তারা তার অবাধ্য হবে। তারা তাঁর বাতি পূর্ণ আশীর্বাদ লাভ করার আগে, তাদের প্রেম ও বাধ্যতার পরীক্ষা নেয়া একান্ত প্রয়ােজন। EdBen 20.1
এদন “উদ্যানের মধ্যস্থানে জীবনবৃক্ষ ও সদস-জ্ঞানদায়ক বৃক্ষ” ছিল। ...আর সদাপ্রভু ঈশ্বর আদমকে এই আজ্ঞা দিলেন, তুমি এই উদ্যানের সমস্ত বৃক্ষের ফল স্বাচ্ছন্দ্যে ভােজন করিও; কিন্তু সদসজ্ঞানদায়ক যে বৃক্ষ, তাহার ফল ভােজন করিও না।” আদিপুস্তক ২:৯১৭। ঈশ্বর চেয়েছিলেন যেন আদম ও হবা পাপ জানতে না পারে। পাপ সম্পর্কিত জ্ঞান, পাপ এবং এর পরিণতি, কঠিন পরিশ্রম উদ্বেগ ও উৎকণ্ঠা, নিরুৎসাহ এবং আর্তস্বর, ব্যথা এবং মৃত্যু—এ সবের মধ্যে প্রেম নেই। EdBen 20.2
এক দিকে ঈশ্বর মানুষের মঙ্গল চেয়েছিলেন, অন্যদিকে শয়তান। তার ধবংস কামনা করেছিল। হবা, নিষিদ্ধ গাছ সম্পর্কে ঈশ্বরের সতর্ক বাণী উপেক্ষা করে তার কছে এগিয়ে গিয়ে বিপদের ঝুঁকি মাথায় নিলেন, এবং তার শত্রুর সামনা-সামনি হলেন। তার আগ্রহ ও কৌতুহল বেড়ে গেল, ফলে শয়তান ঈশ্বরের বাক্য অস্বীকার করল, এবং কল্পিত কৌশল অনুসারে ঈশ্বরের জ্ঞান এবং উত্তমতার প্রতি অবিশ্বাসের ইঙ্গিত দেখাল । নারী সদ-সদ্ জ্ঞান দায়ক বৃক্ষ সম্পর্কে সতর্ক হয়ে বললেন, “তাহার ফলের বিষয় ঈশ্বর বলিয়াছেন, তােমরা তাহা ভােজন করিও না, স্পর্শও করিও না, করিলে মরিবে,” পরীক্ষক আশ্বস্ত করে বলল, “তােমরা কোন ক্রমে মরিবে না : কেননা ঈশ্বর জানেন, যেদিন তােমরা তাহা খাইবে, সেই দিন তােমাদের চক্ষু খুলিয়া যাইবে, তাহাতে তােমরা ঈশ্বরের সদৃশ হইয়া সদস-জ্ঞান প্রাপ্ত হইবে।” আদিপুস্তক ৩:৩-৫। EdBen 20.3
শয়তান চেয়েছিল যেন এই সৎ জ্ঞান, অসৎ জ্ঞানের সঙ্গে মিশে আশীর্বাদস্বরূপ হয়। আর ঐ গাছের ফল খেতে নিষেধ করে ঈশ্বর তাদের নিকট হতে মহা মঙ্গল প্রতিরােধ করছেন। সে সনির্বন্ধ মিনতি সহকারে এই পরামর্শ দিল যে, ঈশ্বর তাদেরকে নিষিদ্ধ গাছের ফল খেতে নিষেধ করেছেন, অর্থাৎ তিনি তাদের চরিত্রের মহা উৎকর্ষ সাধন এবং মহত্তর সুখের পথে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করছেন। সে বলল যে, সে নিজেও এই গাছের ফল খেয়েছে, এবং কথা বলার শক্তি লাভ করেছে; এবং তারাও যদি . তা খায়, তাহলে তাদেরও জ্ঞান-গরিমা বাড়বে এবং তারা জ্ঞানের বিশাল ক্ষেত্রে বিচরণ করবে। EdBen 21.1
শয়তান দাবি করল যে, নিষিদ্ধ গাছের ফল খেয়ে তার মহা মঙ্গল লাভ হয়েছে, কিন্তু সে একটি বিষয় গােপন রেখেছে যে, আজ্ঞালঘন করে সে স্বর্গ হতে বিতাড়িত হয়েছে। এ স্থলেই মিথ্যা প্রচার করা হল, দৃশ্যমান সত্য চাপা পড়ে গেল, তিনি বুদ্ধিভ্রষ্ট হলেন, তাকে তােষামােদ করা হল, তিনি প্রতারিত হলেন, এবং তার সঙ্গে যে প্রতারণা করা হচ্ছে, তাতে তিনি লালায়িত হলেন; তিনি তার জ্ঞানে অবিশ্বাস ও সন্দেহ প্রকাশ করলেন। তিনি জ্ঞানের চাবিকাঠি অর্থাৎ বিশ্বাস দূরে ছুঁড়ে ফেলে দিলেন। EdBen 21.2
হবা যখন দেখলেন, “ঐ বৃক্ষ সুখাদ্যদায়ক ও চক্ষুর লােভজনক, আর ঐ বৃক্ষ জ্ঞানদায়ক বলিয়া বাঞ্ছনীয় তখন তিনি তাহার ফল পাড়িয়া ভােজন করিলেন।” ফল ছিল অত্যন্ত আস্বাদযুক্ত, আর তিনি যখন তা খেলেন তখন মনে হতে লাগল তা অত্যন্ত প্রাণবন্ত, আর তিনি নিজেকে অতি উঁচু মানের মানুষ বলে বিবেচনা করলেন। তিনি নিজে আজ্ঞা লঙ্ঘন করলেন, তিনি তার স্বামীর কাছে একজন প্রলােভনকারী হিসেবে আসলেন, “আর তিনিও উহা ভােজন করিলেন।” আদিপুস্তক ৩:৬। EdBen 21.3
শত্রু বলল, “তােমাদের চক্ষু খুলিয়া যাইবে, তাতে “তােমরা ঈশ্বরের সদৃশ হইয়া সদস-জ্ঞান প্রাপ্ত হইবে।” আদিপুস্তক ৩:৫। প্রকৃতপক্ষেই তাদের চোখ খুলে গেল; কিন্তু এই খুলে যাওয়া কতই-না দুঃখজনক ছিল! তারা আজ্ঞা লঙ্ঘন করলেন; আজ্ঞালন পাপ, আর পাপের অভিশাপ মন্দ বা অসৎ জ্ঞান। ফলের মধ্যে বিষাক্ত এমন কিছুই ছিল না, খাওয়ার ইচ্ছাও পাপ নয়। এটা ছিল ঈশ্বরের উত্তমতা এবং দয়ার প্রতি অবিশ্বাস, তাঁর বাক্যে অবিশ্বাস, তার ক্ষমতা অস্বীকার, আর ঐ সব পৃথিবীতে পাপের জ্ঞান নিয়ে এল। আর তা সৃষ্ট প্রত্যেক মানুষের কাছে মিথ্যা কথা এবং ভ্রান্তির দ্বার খুলে দিল। EdBen 21.4
মানুষ সবই হারাল, কেননা যিনি সত্য, যিনি একমাত্র জ্ঞানী তাঁর কথা পালন না করে, না শুনে, তিনি প্রতারকের কথায় কান দিলেন। ভালাে ও মন্দের মিশ্রণ তার মনকে বিগড়িয়ে দিল, তার মানসিক এবং আধ্যাত্মিক শক্তি কমে গেল। ঈশ্বর তাদের কাছে ভালাে যা কিছু গচ্ছিত রেখেছিলেন, তার জন্য তারা আর কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করতে পারল না। EdBen 22.1
আদম ও হবা মন্দ, অশুভ জ্ঞানের পথ মনােনয়ন করলেন; এবং তারা যা কিছু হারিয়েছেন তা পুনরায় লাভ করতে হলে, তাদের প্রতিকূল অবস্থার মধ্য দিয়েই তা পুনরুদ্ধার করতে হবে। তারা আর এদনে বসবাস করতে পারবেন না, কেননা এখন তাদের যা শিক্ষা করতে হবে, এই সুন্দর মনােরম পরিবেশ তা তাদের শিক্ষা দিতে পারবে না। এক অব্যক্ত দুঃখ ও বেদনা নিয়ে তাদের ঐ মনােরম আবাস থেকে বিদায় নিয়ে পৃথিবীতে পাপের অভিশাপের মধ্যে বসবাস করতে হল। EdBen 22.2
ঈশ্বর আদমকে বললেন, “যে বৃক্ষের ফলের বিষয় আমি তােমাকে বলিয়াছিলাম, তুমি তাহা ভােজন করিও না, তুমি তােমার স্ত্রীর কথা শুনিয়া তাহার ফল ভােজন করিয়াছ, এই জন্য তােমার নিমিত্ত ভূমি অভিশপ্ত হইল; তুমি যাবজ্জীবন ক্লেশে উহা ভােগ করিবে; আর উহাতে তােমার জন্য কষ্টক ও শেয়ালকাটা জন্মিবে, এবং তুমি ক্ষেত্রের ওষধি ভােজন করিবে। তুমি ঘর্মাক্ত মুখে আহার করিবে, যে পর্যন্ত তুমি মৃত্তিকায় প্রতিগমন না করিবে; তুমি ত উহা হইতে গৃহীত হইয়াছ; কেননা তুমি ধূলি, এবং ধূলিতে প্রতিগমন করিবে।” আদিপুস্তক ৩:১৭-১৯। EdBen 22.3
যদিও পৃথিবী অভিশাপে ক্ষয়রােগাক্রান্ত হয়েছে, তথাপি প্রকৃতি এখনওঁ মানব জাতির পাঠ্যপুস্তকরূপে রয়ে গেছে। এটি কেবল এখন আর তার ভালাে বিষয়গুলাে দেখাতে পারে না; কেননা সব জায়গায় মন্দতা বিরাজিত, পৃথিবী সাগর এবং বাতাস এর মলিন স্পর্শে বিকৃত হয়েছে। এক সময় যেখানে ঈশ্বরের চরিত্র, অর্থাৎ নীতি জ্ঞানের কথা লিখিত ছিল, সেখানে এখন শয়তানের চরিত্র, অর্থাৎ পাপ সম্পর্কিত জ্ঞানের কথা লিখিত রয়েছে। যে প্রকৃতি হতে মানুষ অবিরত পাপের পরিণামের সতর্কবাণী লাভ করেছিল তা এখন সদসদ্ জ্ঞান প্রকাশ করল । EdBen 22.4
ক্ষীণ শুষ্ক ফুল ও গাছ থেকে ঝরে পড়া পাতায় আদম এবং তার সহকারিণী এই প্রথম ক্ষয়ের চিহ্নাবলি লক্ষ্য করলেন। তাদের মনে সত্য ভেসে উঠল যে, প্রত্যেক জীবন্ত বস্তুকে মৃত্যুবরণ করতে হবে। এমন কি যে বাতাসের ওপর আমরা নির্ভরশীল তাও মৃত্যুর বীজ ধারণ করল। EdBen 23.1
অবিরত তাদের হারানাে মালিকানা এবং রাজত্ব সম্পর্কে স্মরণ করিয়ে দেয়া হত। নিম্ন স্তরের সৃষ্ট জীবগণের মধ্যে আদম ছিলেন রাজা, এবং যত দিন যাবৎ তিনি ঈশ্বরের আজ্ঞাবহ ছিলেন, ততদিন প্রকৃতি তার শাসন মেনে চলেছে, কিন্তু যখন তারা আজ্ঞা লঙ্ঘন করলেন, তখনই তারা তাদের প্রভুত্ব হারালেন। যে বিদ্রোহের আত্মা তার মধ্যে স্থান পেয়েছিল, তা সমুদয় সৃষ্ট জীব-জগতে ছড়িয়ে পড়ল। এভাবে, কেবল মানুষের জীবন নয়, বনের পশু, বৃক্ষরাজি, ক্ষেত্রের তৃণরাজি, তার প্রতিটি শ্বাস-প্রশ্বাস, সকলেই অশুভ জ্ঞানের দুঃখদায়ক শিক্ষাটি ব্যক্ত করল। EdBen 23.2
তবুও মানুষ এই মন্দ বিষয় মনােনয়নের পরিণতি ভােগ করেও সম্পূর্ণরূপে হাল ছেড়ে দেয় নি। শয়তানের কাছে উচচারিত বাণীর মাধ্যমে তাদের কাছে মুক্তির আশ্বাস প্রদান করা হল। ঈশ্বর বললেন, “আমি তােমাতে ও নারীতে, তােমার বংশে এবং তাহার বংশে পরস্পর শত্রুতা জন্মাইব, সে তােমার মস্তক চূর্ণ করিবে, এবং তুমি তাহার পাদমূল চূর্ণ। করিবে।” আদিপুস্তক ৩:১৫। আমাদের সর্ব প্রথম পিতা-মাতার কাছে বলা ঈশ্বরের এই বাক্যটি ছিল তাদের কাছে একটি প্রতিজ্ঞা। কণ্টক ও শিয়ালকাটা, পরিশ্রম এবং দুঃখভােগ ধুলিতে প্রতিগমন, ইত্যাদি করার আগে তারা আশার বাণী শুনেছিলেন। শয়তানের কথা শুনে তারা যা হারিয়েছেন, খ্রীষ্টের মাধ্যমেই তা পুনরুদ্ধার সম্ভব হবে। EdBen 23.3
প্রকৃতিও আমাদের কাছে এই প্রগাঢ় ঘনিষ্টতার পুনরুক্তি করে। থাকে। যদিও পাপে বিকৃত, তথাপি এটি কেবল সৃষ্টির কথা নয়, কিন্তু মুক্তির কথাও প্রচার করে। যদিও পৃথিবী অভিশাপের সাক্ষ্য বহন করে, তথাপি এটি জীবনদায়ী শক্তির চিহ্নের মধ্যে অতিশয় সমৃদ্ধশালী এবং চমৎকার। গাছ-পালা থেকে পাতা ঝরে পড়ে এবং নতুন পাতা গজায়, ফুল শুষ্ক হয়ে মরে যায়, পুনরায় নতুন সৌন্দর্য নিয়ে নতুন ফুল দেখা দেয়, এদের প্রত্যেকটিতে সৃজনীশক্তির নিশ্চয়তা রয়েছে, যেন আমরা “সত্যের ধার্মিকতায় ও সাধুতায়” (ইফিষীয় ৪:২৪) নতুন সৃষ্টি হতে পারি। এভাবে প্রকৃতির কার্যপ্রণালী যা আমাদের কাছে মহা ক্ষতি বলে মনে হয়, তা আমাদের কাছে আশার বার্তাবাহক। যেমন মন্দতা বাড়ছে, আমাদের পিতার স্বর শােনা যাচ্ছে, তিনি তাঁর সন্তানদের পাপের পরিণাম বুঝে তাদের পাপের পথ পরিত্যাগ করার সতর্কবাণী ঘােষণা করছেন, এবং তাদের উত্তমকে গ্রহণ করার আমন্ত্রণ জানাচ্ছেন। EdBen 23.4