বিলম্বে বিপদ
রাত্রিকালে দর্শনে এক অতীব রিদয়গ্রাহী দৃশ্য আমার সম্মুখ দিয়া অতিক্রম করিয়া গেল। আমি দেখিলাম এক অতি প্রকাণ্ড অগ্নিগোলক কতকগুলি সুরম্য অট্টালিকার উপরে পতিত হইয়া সেগুলিকে তৎক্ষণাৎ ধূলিসাৎ করিয়া দিল। আমি একজনকে বলিতে শুনিলাম, “আমরা জানিতাম যে, পৃথিবীর উপরে ঈশ্বরের ন্যায় বিচার আসিয়া পড়িতেছে, কিন্তু উহা যে এত শীঘ্র আসিয়া পড়িবে, তাহা আমরা জানিতাম না।” অন্যেরা ব্যথিত কন্ঠে বলিয়া উঠিল, “তোমরা যখন ইহা জানিতে, তখন কেন আমাদিগকে বল নাই? আমরা তো কিছুই জানিতাম না।” সর্ব্বত্র ঐ একই তিরস্কার বাণী শ্রুত হইল।CCh 126.1
অত্যন্ত ক্লিষ্ট মনে জাগরিত হইয়া পুনরায় যখন নিদ্রা গেলাম, তখন আমার মনে হইল যেন, আমি এক বৃহৎ জনসভায় উপস্থিত আছি আর একজন প্রভাবশালী ব্যক্তি উক্ত জনতার সমক্ষে পৃথিবীর মানচিত্র লটকাইয়া উপদেশ দিতে দিতে কহিলেন, “উক্ত মানচিত্র ঈশ্বরের দ্রাক্ষাক্ষেত্র, এই ক্ষেত্রের চাষ-আবাদ করিতে হইবে।” কাহারও উপরে স্বর্গীয় জ্যোতি উদিত হইলে, তাহারাও অন্যের নিকটে সেই জ্যোতি প্রতিবিম্বিত করা কর্ত্তব্য। বহু স্থানে জ্যোতি প্রজ্বলিত করিতে হইবে এবং এই সকল জ্যোতি হইতে আরও জ্যোতি জ্বালাইতে হইবে।CCh 126.2
“তোমরা জগতের লবণ, কিন্তু লবণের স্বাদ যদি চলিয়া যায়, তবে তাহা কি প্রকারে লবণের গুণবিশিষ্ট করা যাইবে? তাহা আর কোন কার্য্যে লাগে না, কেবল বাহিরে ফেলিয়া দিবার ও লোকের পদতলে দলিত হইবার যোগ্য হয়। তোমরা জগতের দীপ্তি; পর্ব্বতের উপরে স্থিত নগর গুপ্ত থাকিতে পারে না। আর লোকে প্রদীপ জ্বালিয়া কাঠার নীচে রাখে না, কিন্তু দীপাধারের উপরেই রাখে, তাহাতে তাহা গৃহস্থিত সকল লোককে আলো দেয়। তদ্রুপ তোমাদের দীপ্তি মনুষ্যদের সাক্ষাতে উজজ্বল হউক, যেন তাহারা তোমাদের সৎক্রিয়া দেখিয়া তোমাদের স্বর্গস্থ পিতার গৌরব করে।” মথি ৫:১৩-১৬। - এই সকল কথার বার বার পুনরুক্তি করা হইল।CCh 126.3
যে দিনটী গত হইয়া যায়, তাহা আমাদিগকে শেষকালের অধিকতর নিকটে আনিয়া ফেলে। ইহা কি আমাদিগকে ঈশ্বরেরও নিকটে আনিয়া দেয়? আমরা কি প্রার্থনায় জাগ্রত আছি? প্রতিদিন আমরা যাহাদের সংস্পর্শে আইসি, তাহারা আমাদের সাহায্য ও পরিচালনা চাহে। তাহাদের মনের অবস্থা হয়তো এমন যে, যথাস্থানে একটী প্রেক বিদ্ধ করিলে, তাহা যেমন উপযুক্ত হয়, ঐ অবস্থায় পবিত্র আত্মা দ্বারা চালিত হইয়া একটী মাত্র কথা বলিলেও, তাহা তেমন উপযুক্ত হয়। আগামী কল্য এই সকল আত্মা হয়তো এমন একটী স্থানে গিয়া পড়িবে, যে স্থানে যাইয়া, আমরা পুনরায় কখনও তাহার সহিত সাক্ষাৎ করিতে পারিব না। এই সকল সহ- যাত্রিগণের উপরে আমাদের প্রভাব কিরূপ? ইহাদিগকে খ্রীষ্টের নিকটে আনিবার জন্য আমরা কিরূপ চেষ্টা করি?CCh 127.1
দূতগণ যতক্ষণ চারি বায়ু ধরিয়া রাখিতেছেন, ততক্ষণ আমাদের সমস্ত শক্তির সহিত কার্য্য করিতে হইবে। স্বর্গীয় বিশ্বের নিকটে এবং এই পাপ জগতের মানবের নিকটে সাক্ষ্য দিতে হইবে যে, আমাদের ধর্ম্ম, - বিশ্বাসের ও শক্তির ধর্ম্ম, -খ্রিষ্ট ইহার আদিকর্ত্তা, এবং তাঁহার বাক্য ঐশ্বরিক প্রত্যাদেশ বা দৈববাণী। মানব-আত্মাগুলির তৌল করা হইতেছে। তাহারা হয় ঈশ্বরের রাজ্যের প্রজা, না হয়, শয়তানের স্বৈরতন্ত্রের ক্রীত দাস। সুসমাচারে যে প্রত্যাশা রহিয়াছে, তাহা ধরিবার জন্য প্রত্যেককেই সুযোগ দেওয়া কর্ত্তব্য; কিন্তু প্রচারক না থাকিলে তাহারা কি প্রকারে সুসমাচার শুনিবে? মানব পরিবার যেন ঈশ্বরের সম্মুখে দাঁড়াইতে পারে, এজন্য তাহাদের নৈতিক নবভাব পুনঃপ্রাপ্তির ও চরিত্র সংশোধনের প্রয়োজন। যে সকল প্রবল কাল্পনিক ভ্রান্তি সুসমাচারের বিরুদ্ধাচারী বলিয়া গণ্য, তাহাদের প্রভাবে পড়িয়া বহু আত্মা বিনষ্ট অইতে যাইতেছে। ঈশ্বরের সহকার্য্যকারী হইবার নিমিত্ত, কে কে এক্ষণে তাহাদের জীবন সম্পূর্ণরূপ উৎসর্গ করিবে?CCh 127.2
যাহাদের লইয়া আমাদের সমাজ গঠিত, তাহাদের অধিকাংশই অধুনা অপরাধে বা পাপে মৃত। কব্জার উপরে যেমন দ্বার চালিত হয়, তেমনি ইহারা মণ্ডলীর মধ্যে আসে এবং যায়। বহু বৎসর যাবৎ তাহারা অতি পবিত্র ও প্রাণস্পর্শী সত্য সমুহ প্রসন্ন চিত্তে শুনিয়া আসিতেছে, কিন্তু তাহারা ঐ সকল সত্যানুযায়ী জীবন যাপন করিতেছে না। এই জন্য তাহারা বহুমূল্যে সত্যের তত্ত্বজ্ঞান দিনের পর দিন, ক্রমাগত হারাইয়া ফেলিতেছে। তাহাদের চেতনাশক্তি এত কমিয়া গিয়াছে যে, ভর্ৎসনা ও চেতনাপূর্ণ উদ্দীপনাময় সাক্ষ্যসমূহের দ্বারাও তাহদের মনে অনুতাপের সঞ্চার হইতেছে না। -“বিশ্বাস দ্বারা ধার্ম্মিক গণিত এবং খ্রীষ্টের ধার্ম্মিকতা” — ঈশ্বর হইতে এই যে সমুধুর সঙ্গিত ধ্বনি মানবোষ্ঠে বিঘোষিত হয়, ইহাতেও তাহাদের মনে প্রেমের ও কৃতজ্ঞতার উদ্রেক হয় না। স্বর্গীয় বণিক তাহাদের সম্মুখে বিশ্বাসের ও প্রেমের সর্ব্বাপেক্ষা ও বহুমূল্য রত্নাদি স্থাপন করিয়া ধনবান হইবার নিমিত্ত “অগ্নি দ্বারা পরিষ্কৃত স্বর্ণ,” বস্ত্র পরিহিত হইবার নিমিত্ত, “শুক্লবস্ত্র” এবং দেখিবার নিমিত্ত, চক্ষুতে “লেপনীয় অঞ্জন” ক্রয় করিতে আহ্বান করিলেও, তাহারা ঈশ্বরের বিরুদ্ধে তাহাদের অন্তঃকরণ ইস্পাত-বৎ কঠিন করিয়া রাখে এবং প্রেম ও উদ্যোগ গ্রহণ না করিয়া, কদুষ্ণ অবস্থায় পড়িয়া থাকে এবং ধর্ম্মের ভাণ করিয়া ভক্তির শক্তি অস্বীকার করে। তাহারা যদি ক্রমাগত এই অবস্থার মধ্যে পড়িয়া থাকে, তবে ঈশ্বর তাহদিগকে অগ্রাহ্য করিবেন। কারণ তাহারা আপনাদিগকে ঈশ্বরের পরিবারের সভ্য হইবার অনুপযুক্ত করিয়া গঠন করিতেছে।CCh 128.1
মণ্ডলীর সভ্যদিগের স্মরণে রাখা কর্ত্তব্য যে, মণ্ডলীর খাতায় তাহাদের নাম থাকিলে যে তাহারা রক্ষা পাইবে, এমন নহে। তাহাদের আপনাদিগকে ঈশ্বরের কাছে পরীক্ষাসিদ্ধ লোক দেখাইতে হইবে এবং এমন কার্য্যকারী হইতে হইবে, যাহাদের লজজা করিবার প্রয়োজন নাই। খ্রীষ্টের নির্দ্দেশানুযায়ী, তাহাদের চরিত্র, দিনের পর দিন গঠন করিয়া তুলিতে হইবে। তাঁহাতে অবিরত বিশ্বাস রাখিয়া, তাঁহাতেই থাকিতে হইবে। তাহা হইলে, এইরূপে খ্রীষ্টে তাহারা সিদ্ধ পুরুষ ও সিদ্ধ স্ত্রীর পর্য্যত্ন বৃদ্ধি পাইবে, - তাহারা উপকারী, আনন্দিত ও কৃতজ্ঞ খ্রীষ্টীয়ান হইবে, আর ঈশ্বর তাহাদিগকে স্পষ্ট হইতে স্পষ্টতর জ্যোতিতে চালাইয়া লইয়া যাইবেন। তাহাদের অভিজ্ঞতা যদি এইরূপ না হয়, তবে তাহারা এই শ্রেণীর লোকদের মধ্যে গণ্য হইবে, যাহারা মর্ম্মান্তিক দুঃখের সহিত একদিন বলিয়া উঠিবে, “শস্য কাটিবার সময় গেল, ফল চয়নের কাল শেষ হইল, কিন্তু আমাদের পরিত্রাণ হয় নাই! আহা! আমি কেন আশ্রয় দুর্গে যাই নাই? আমি কেন আমার পরিত্রাণ তুচ্ছ করিয়াছি এবং অনুগ্রহের আত্মার অবমাননা করিয়াছি?”CCh 129.1
প্রিয় ভ্রাতা ও ভগ্নিগণ, আপনারা যাহারা বহু বৎসর যাবৎ সত্য বিশ্বাস করিয়া আসিতেছেন বলিয়া দাবী করেন, আমি আপনাদের প্রত্যেককে ব্যক্তিগতভাবে জিজ্ঞাসা করি, আপনি যে দীপ্তি পাইয়াছেন এবং স্বর্গ হইতে যে সুযোগ-সুবিধা লাভ করিয়াছেন, আপনি কি তদনুযায়ী জীবন যাপন করিতেছেন? এ একটী গুরুতর প্রশ্ন! মণ্ডলীর উপরে ধর্ম্মসূর্য্য উদিত হইয়াছে; অতএব এক্ষণে মণ্ডলীর কর্ত্তব্য দীপ্তি প্রদান করা। প্রত্যেক ব্যক্তিরই ধর্ম্ম-পথে অগ্রসর হওয়ার সুযোগ রহিয়াছে। যাহারা খ্রীষ্টের সহিত সংযুক্ত তাহারা অনুগ্রহে এবং ঈশ্বরের পুত্রের তত্ত্বজ্ঞানে, সিদ্ধ পুরুষ ও স্ত্রীর অবস্থা পর্য্যন্ত বৃদ্ধি পাইবে! যাহারা সত্যে বিশ্বাসী বলিয়া দাবী করে, তাহারা যদি তাহাদের দক্ষতা ও সুযোগ-সুবিধার অধিকাংশ ভাগই শিক্ষার ও কার্য্য সম্পাদনের নিমিত্ত ব্যয় করিত, তবে তাহারা খ্রীষ্টে বলবান হইতে পারিত। তাহাদের ব্যবসায় যাহাই হউক না কেন, - তাহারা কৃষক কিংবা শিল্পী, কিংবা শিক্ষক অথবা পালক- যে কেহই হউক না কেন, তাহারা যদি ঈশ্বরে সম্পূর্ণ আত্ম-সমর্পণ করে, তাহা হইলে স্বর্গীয় গুরুর জন্য তাহারা সুযোগ্য কার্য্যকারী হইতে পারে।CCh 129.2